পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ডাক্তার অন্যমনস্কের মত একটুখানি হাসিয়া কহিলেন, সবাই কি ভালই আমাকে বাসে। কিন্তু ঘুমে যে আর চোখ চাইতে পারিনে ভারতী, কিছু একটা কর! কিন্তু তার আগে সে লোকটা গেল কোথায় একবার খোঁজ করবে না?

 আপনি কিন্তু কারও কাছে গল্প করতে পারবেন না।

 না। কিন্তু আমাকে বুঝি লজ্জা করবার দরকার নেই!

 ভারতী মাথা নাড়িয়া বলিল, না। মানুষের কাছেই শুধু মানুষের লজ্জা করে। এই বলিয়া সে হ্যারিকেন লণ্ঠনটা হাতে তুলিয়া লইয়া বাহিরে চলিয়া গেল।

 মিনিট দশ-পনেরো পরে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, অপূর্ব্ববাবু চলে গেছেন।

 ডাক্তার বিস্ময়ে উঠিয়া বসিয়া কহিলেন, এই অন্ধকারে? একা?

 তাই ত দেখচি।

 আশ্চর্য্য।

 ভারতী বলিল, আমার বিছানা করা আছে, শুতে চলুন।

 তুমি?

 আমি মেঝেতে একটা কম্বল-টম্বল কিছু পেতে নেব। চলুন।

 ডাক্তার উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, তাই চল। লজ্জা সঙ্কোচ মানুষ মানুষকেই করে,—আমি পাষাণ বই ত নয়।

 উপরের ঘরে গিয়ে ডাক্তার শয্যায় শয়ন করিলে ভারতী মশারী ফেলিয়া দিয়া সযত্নে চারিদিক গুঁজিয়া দিল, এবং তাহারই অনতিদূরের মেঝের উপর আপনার বিছানা পাতিল। ডাক্তার সেই দিকে চাহিয়া ক্ষুব্ধ কণ্ঠে কহিলেন, সকলে মিলে আমাকে এমন করে অগ্রাহ্য করলে আমার আত্মসম্মানে আঘাত লাগে।

 ভারতী হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, আমরা সকলে মিলে আপনাকে মানুষের দল থেকে বার করে পাথরের দেবতা বানিয়ে রেখেছি।

 তার মানে আমাকে ভয়ই নেই?

 ভারতী অসঙ্কোচে জবাব দিল, একবিন্দু না। আপনার থেকে কারও লেশমাত্র অকল্যাণ ঘটতে পারে এ আমরা ভাবতেই পারিনে।

 প্রত্যুত্তরে ডাক্তার হাসিয়া শুধু বলিলেন, আচ্ছ। টের পাবে একদিন।

 শয্যা গ্রহণ করিয়া ভারতী হঠাৎ প্রশ্ন করিল, আচ্ছা কে আপনাকে সব্যসাচী নাম দিলে ডাক্তারবাবু? এত আপনার আসল নাম নই।

 ডাক্তার হাসিতে লাগিলেন। কহিলেন, আসল যাই হোক, নকল নামটি দিয়ে ছিলেন আমাদের পাঠশালার পণ্ডিতমশাই, তাঁর মস্ত উঁচু একটা আমগাছ ছিল, কেবল আমিই তার ঢিল মেরে আম পাড়তে পারতাম। একবার ছাত-থেকে লাফাতে

১৬৮