পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কিন্তু আজও তার কাকুতি মিনতি, আজও তার মরণ-চীৎকার যেন মাঝে মাঝে কানে শুনতে পাই। উঃ—সে কি ভয়ানক বুক-ফাটা আর্ত্তনাদ!

 ভারতী নিরুদ্ধশ্বাসে কহিল, তার পর?

 ডাক্তার কহিলেন, তারপর বাবাজীর জীবন ভিক্ষার শেষ অনুনয় সমস্ত গ্রামের সম্মুখে ধীরে ধীরে সাঙ্গ হল, তাদের লুট-পাটের কাজও নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগে পরিসমাপ্ত হল—চলে যাবার সময় সর্দ্দার বড়দাদার উদ্দেশ্যে পিতৃ-উচ্চারণ করে শপথ করে গেল যে, আজ তারা শ্রান্ত কিন্তু মাসখানেক পরে ফিরে এসে এর শোধ দেবে। বড়দা জেলার সাহেব ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়ে কেঁদে কেটে পড়লেন একটা বন্দুক চাই। কিন্তু পুলিশ বললে, না। বছর দুই পূর্ব্বে একজন অত্যন্ত অত্যাচারী পুলিশ সাবইন্‌স্পেক্টরের কান মলে দেবার অপরাধে তাঁর দুমাস জেল হয়েছিল এবং এই অপরাধেই সাহেব ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, কোন মতেই না। দাদা বললেন, সাহেব, আমরা কি তবে মারা যাবো? সাহেব হেসে বললেন, এত যার ভয় সে যেন ঘর বাড়ি বেচে আমার জেলা থেকে অন্য জেলায় চলে যায়।

 ভারতী উত্তেজনার বিছানার উঠিয়া বসিয়া কহিল, দিলে না? এতবড় সর্ব্বনাশ আসন্ন জেনেও দিলে না?

 ডাক্তার কহিলেন, এবং কেবল তাই নয়, বড়দা ব্যাকুল হয়ে যখন তীর ধনুক ও বর্শা তৈরী করালেন, পুলিশের লোক খবর পেয়ে সেগুলো পর্য্যন্ত কেড়ে নিয়ে গেল।

 কি হল তার পর?

 ডাক্তার বললেন, তার পরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত। সেই মাসের মধ্যে সর্দ্দার তার প্রতিজ্ঞা পালন করলে। এবারে বোধ করি আরও একটা বেশী বন্দুক ছিল। বাড়ির আর সকলেই পালালেন, শুধু বড়দাকে কেউ নড়াতে পারলে না। কাজেই ডাকাতের গুলিতে প্রাণ দিলেন।

 ভারতী রক্তহীন পাংশুমুখে বলিয়া উঠিল, প্রাণ দিলেন?

 ডাক্তার কহিলেন, হাঁ, ঘণ্টা চারেক সজ্ঞানে বেঁচে ছিলেন। গ্রামসুদ্ধ জড় হয়ে হৈ চৈ করতে লাগলো, কেউ ডাকাতদের, কেউ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে গাল পাড়তে লাগলো, শুধু দাদাই কেবল চুপ করে রইলেন! পাড়াগাঁ, হাসপাতাল দশ বারো ক্রোশ দূরে রাত্রিকাল, গ্রামের ডাক্তার ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিতে এলে তাঁর হাতটা দাদা সরিয়ে দিয়ে কেবল বললেন, থাক্ আমি আর বাঁচতে চাইনে। বলতে বলতে সেই পাষাণ দেবতার কণ্ঠস্বর হঠাৎ একটুখানি যেন কাঁপিয়া গেল। ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া পুনশ্চ কহিলেন, বড়দা আমাকে বড় ভালবাসতেন। কাঁদতে দেখে

১৭০