পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হইয়া আজ এমন অভ্রভেদী হইয়া উঠিয়াছে যে, আমাদের প্রতি অন্যায়ের ধিক্কার সে উচ্চ শিখরে আর পৌঁছিতে পর্য্যন্ত পারে না। নিঃশব্দে ও নির্ব্বিচারে সহ্য করাকেই কেবল নিজেদের কর্ত্তব্য করিয়া তুলিয়াছি বলিয়া অপরের আঘাত করিবার অধিকার এমন স্বতঃই সুদৃঢ় ও উগ্র হইয়া উঠিয়াছে। তাই আজ আমার চাকরটা পর্য্যন্ত আমাকে অবিলম্বে পলাইয়া আত্মরক্ষার উপদেশ দিতে পারিল, লজ্জা-সরমের প্রশ্ন পর্য্যন্ত তাহার মনে উদয় হইল না! কিন্তু সে বেচারা রান্নাঘরে বসিয়া চিঁড়া-মুড়কির ফলাহার প্রভুর জন্য সযত্নে প্রস্তুত করিতে লাগিল, জানিতেও পারিল না তাহারি পরিত্যক্ত মোটা বাঁশের লাঠিটা হাতে করিয়া অপূর্ব্ব নিঃশব্দ পদে বাহির হইয়া সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিয়া গেল।

 দ্বিতলে সাহেবের দরজা বন্ধ ছিল, সেই রুদ্ধ দ্বারে গিয়া সে বারংবার আঘাত করিতে লাগিল। কয়েক মুহূর্ত্ত পরে ভীত নারীকণ্ঠে ইংরাজীতে সাড়া আসিল, কে?

 অপূর্ব্ব কহিল, আমি নীচে থাকি। সেই লোকটাকে একবার চাই।

 কেন?

 তাকে দেখাতে চাই সে আমার কত ক্ষতি করেচে। তার ভাগ্য ভাল যে আমি ছিলাম না।

 তিনি শুয়েচেন।

 অপূর্ব্ব অত্যন্ত পুরুষকণ্ঠে কহিল, তুলে দিন, এ শোবার সময় নয়। রাত্রে শুলে আমি বিরক্ত করতে আসব না। কিন্তু এখন তার মুখের জবাব না নিয়ে আমি এক পা নড়ব না। এবং ইচ্ছা না করিলেও তাহার হাতের মোটা লাঠিটা কাঠের সিঁড়ির উপরে ঠকাস্ করিয়া একটা মস্ত শব্দ করিয়া বসিল।

 কিন্তু দ্বারও খুলিল না কোন জবাবও আসিল না। মিনিট-দুই অপেক্ষা করিয়া অপূর্ব্ব পুনশ্চ চীৎকার করিল, আমি কিছুতেই যাব না,—বলুন তাকে বাইরে আসতে।

 ভিতরে যে কথা কহিতেছিল এবার সে রুদ্ধদ্বারের একান্ত সন্নিকটে আসিয়া নম্র ও অতিশয় মৃদুকণ্ঠে কহিল, আমি তাঁর মেয়ে। বাবার হয়ে আপনার কাছে আমি ক্ষমা চাইচি। তিনি যা কিছু করেচেন সজ্ঞানে করেননি। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন, আপনার যত ক্ষতি হয়েচে কাল আমরা তার যথাসাধ্য ক্ষতিপূরণ কোরব।

 মেয়েটির কোমল স্বরে অপূর্ব্ব নরম হইল, কিন্তু তাহার রাগ পড়িল না। কহিল, তিনি বর্ব্বরের মত আমার যথেষ্ট লোকসান এবং ততোধিক উৎপাত করেচেন। আমি বিদেশী লোক বটে, কিন্তু আশা করি কাল সকালে নিজে দেখা করে আমার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করবার চেষ্টা করবেন।

১৪