পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ভারতী জিজ্ঞাসা করিল, তেওয়ারী আছে ত?

 আছে।

 উপরে উঠিরা দ্বারে করাঘাত করিয়া অপূর্ব্ব তেওয়ারীর ঘুম ভাঙ্গাইল; কপাট খুলিয়া তেওয়ারী দীপালোকে প্রথমেই দেখিতে পাইল ভারতীকে। কাল অপূর্ব্ব বাসায় ফিরিয়াছিল প্রায় ভোরবেলায়, আজ ফিরিয়াছে রাত্রি শেষ করিয়া। সঙ্গে আছে ভারতী। তাই বুঝিতে তেওয়ারীর বাকি কিছুই রহিল না; ক্রোধে সর্ব্বাঙ্গ জ্বলিতে লাগিল এবং একটা কথাও না কহিয়া সে দ্রুতবেগে নিজের বিছানায় গিয়া চাদর মুড়ি দিয়া শুইয়া পড়িল। এই মেয়েটিকে তেওয়ারী ভালবাসিত, একদিন তাহাকে আসন্ন মৃত্যুমুখ হইতে রক্ষা করিয়াছিল বলিয়া খ্রীষ্টান হওয়া সত্ত্বেও মনে মনে শ্রদ্ধা করিত। কিন্তু, কিছুদিন হইতে ব্যাপার যেরূপ দাঁড়াইয়াছিল, তাহাতে অপূর্ব্বর সম্বন্ধে নানা প্রকার অসম্ভব দুশ্চিন্তা তেওয়ারীর মনে উঠিতেছিল—এমন কি জাতিনাশ পর্য্যন্তও। সেই সর্ব্বনাশের প্রকট মূর্ত্তি আজ যেন তেওয়ারীর মানসপটে একেবারে মুদ্রিত হইয়া গেল। তাহাকে এমন করিয়া শুইয়া পড়িতে দেখিয়া কেবল অভ্যাসবশতঃই অপূর্ব্ব জিজ্ঞাসা করিল, দোর দিলিনি তেওয়ারী?

 তাহার মুর্চ্ছাহত উদভ্রান্ত চিত্ত লক্ষ্য কিছুই করে নাই, কিন্তু লক্ষ্য করিয়াছিল ভারতী। সে-ই তাড়াতাড়ি জবাব দিল, আমি বন্ধ করে দিচ্ছি।

 অপূর্ব্ব শোবার ঘরে আসিয়া দেখিল, খাটের উপর শয্যা তেমনি গুটানো রহিয়াছে, পাতা হয় নাই। বস্তুতঃ বারান্দায় বসিয়া পথ চাহিয়া থাকিতেই আজ তেওয়ারীর সমস্ত সন্ধ্যাটা গিয়াছে, বিছানা করার কথা মনেও পড়ে নাই। কিন্তু সে উত্তর দিবার পূর্ব্বেই ভারতী ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, আপনি আরাম কেদারটায় একটুখানি বসুন, আমি এক মিনিটে সব ঠিক করে দিচ্চি।

 চেয়ারে হেলান দিয়া পড়িয়া অপূর্ব্ব পুনশ্চ ডাকিল, এক গেলাস জল দে তেওয়ারী।

 তাহার পাশের টুলের উপরেই খাবার জলের কুঁজা ও গেলাস ছিল, বিছানা পাতিতে পাতিতে তাহা দেখাইয়া দিয়া ভারতী বলিল, ঘুমন্ত মানুষকে আর কেন তুলবেন অপূর্ব্ববাবু, আপনি নিজেই একটু ঢেলে নিন।

 অপূর্ব্ব হাত বাড়াইয়া কুঁজাটা তুলিতে গিয়া তুলিতে পারিল না; তখন উঠিয়া আসিয়া কোনমতে জল গড়াইয়া লইয়া এক নিশ্বাসে তাহা পান করিয়া পুনরায় বসিতে যাইতেছিল, ভারতী মানা করিয়া কহিল, আর ওখানে না, একেবারে বিছানায় শুয়ে পড়ুন।

 অপূর্ব্ব শান্ত বালকের ন্যায় নিঃশব্দে আসিয়া চোখ বুজিয়া শুইয়া পড়িল।

১৮২