পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভারতী মশারী ফেলিয়া ভাল করিয়া গুঁজিয়া দিতেছিল, অপূর্ব্ব হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কোথায় শোবে?

 আমি? ভারতী কিছু আশ্চর্য্য হইল। কারণ, এইরূপ ঘটনা নূতনও নয় এবং এ ঘরের কোথায় কি আছে তাহাও অবিদিত নয়। এই অনাব্যক প্রশ্নের উত্তরে সে শুধু আরাম চৌকিটা দেখাইয়া দিয়া বলিল, সকাল হতে আর ঘণ্টা দুই মাত্র দেরি আছে। ঘুমোন।

 অপূর্ব্ব হাত বাড়াইয়া তাহার হাতটা ধরিয়া ফেলিয়া বলিল, না ওখানে নয়, তুমি আমার কাছে বোস।

 আপনার কাছে? বাস্তবিকই ভারতীর বিস্ময়ের অবধি রহিল না। অপূর্ব্ব আর যাহাই হৌক, এ সকল ব্যাপারে কখনও আত্মবিস্মৃত হইত না। এমন কতদিন কত উপলক্ষ্যেই ত তাহারা একঘরে রাত্রি যাপন করিয়াছে, কিন্তু মর্য্যাদাহানিকর একটা কথা, একটা ইঙ্গিতও কোনদিন তাহার আচরণে প্রকাশ পায় নাই।

 অপূর্ব্ব কহিল, এই দেখ, এরা আমার হাত ভেঙে দিয়েছে। কেন তুমি এদের মধ্যে আমাকে টেনে আনলে? তাহার কথার শেষ দিকটা অকস্মাৎ কান্নায় রুদ্ধ হইয়া গেল। ভারতী মশারীর একটা দিক তুলিয়া দিয়া তাহার কাছে বসিল, পরীক্ষা করিয়া দেখিল, বহুক্ষণ ধরিয়া শক্ত বাঁধনের ফলে হাতের স্থানে স্থানে কালশিরা পড়িয়া ফুলিয়া আছে। চোখ দিয়া তাহার জল পড়িতেছিল, ভারতী আঁচল দিয়া তাহা মুছাইয়া লইয়া সাহস দিয়া বলিল, কিচ্ছু ভয় নেই, তোয়ালে ভিজিয়ে আমি ভাল করে জড়িয়ে দিচ্চি, দু-এক দিনেই সমস্ত ভাল হয়ে যাবে। এই বলিয়া সে উঠিয়া গিয়া স্নানের ঘর হইতে একটা গামছা ভিজাইয়া আনিল এবং সমস্ত নীচের হাতটা বাঁধিয়া দিয়া স্নিগ্ধকণ্ঠে কহিল, একটু ঘুমোবার চেষ্টা করুন, আমি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্চি। এই বলিয়া সে ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল।

 অপূর্ব্ব অশ্রুবিকৃত-স্বরে বলিল, কাল জাহাজ থাকলে আমি কালই চলে যেতুম!

 ভারতী কহিল, বেশ ত পরশুই যাবেন। একটা দিনের মধ্যে আপনার কোন অমঙ্গল হবে না।

 অপূর্ব্ব ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া কহিতে লাগিল, গুরুজনের কথা না শুনলেই এই সব ঘটে। মা আমাকে পুনঃ পুনঃ নিষেধ করেছিলেন।

 মা বুঝি আপনাকে আসতে দিতে চাননি?

 না, একশবার মানা করেছিলেন, কিন্তু আমি শুনিনি। তার ফল হ’ল এই যে, কতকগুলো ভয়ানক লোকের একেবারে চিরকালের জন্য বিষ দৃষ্টিতে পড়ে

১৮৩