পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পারে না। আমার কলেজের ছেলেরা আমাকে ছি ছি করতে থাকবে, আমি উত্তর দিতে পারব না।

 যা হোক কিছু একটা বলে দেবেন। আচ্ছা আপনি ঘুমোন, এই বলিয়া ভারতী উঠিয়া দাঁড়াইল।

 আরও একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দাও না ভাবতী!

 না, আমি বড় ক্লান্ত।

 তবে থাক্‌, থাক্‌। রাতও আর নেই।

 ভারতী পাশের ঘরে আসিয়া দেখিল, আলোটা তখনও মিট মিট করিয়া জ্বলিতেছে এবং তেওয়ারী তেমনি চাদর মুড়ি দিয়া ঘুমাইতেছে। অদূরে ভাঙাগোছের একখানা ডেক চেয়ার পড়িয়াছিল তাহাতেই আসিয়া সে উপবেশন করিল। অপূর্ব্বর ঘরে ভাল আরাম চৌকি ছিল, কিন্তু ঐ লোকটিকে সুমুখে রাখিয়া একই ঘরের মধ্যে রাত্রি যাপন করিতে আজ তাহার অত্যন্ত ঘৃণা বোধ হইল। চেয়ারটায় কোনমতে একটু হেলান দিয়া পড়িয়া মনের মধ্যে যে তাহার কি করিতে লাগিল তাহার সীমা নাই। ইতিপূর্ব্বে এই ঘরের মধ্যেই সে একাধিকবার কঠিন ধাক্কা খাইয়াছে, কিন্তু আজিকার সহিত তাহার তুলনা হয় না। ভারতীর প্রথমেই মনে হইল, কি করিয়া এবং কাহার অপরিসীম করুণায় অপূর্ব্ব সুনিশ্চিত ও প্রত্যাসন্ন মৃত্যুর হাত হইতে আজ রক্ষা পাইল, অথচ রাত্রিটাও প্রভাত হইল না, এতবড় কথাটা সে ভুলিয়াই গেল! তাহার পরম বন্ধু তলওয়ারকরের প্রতি, এবং বিশেষ করিয়া এই ডাক্তার লোকটির প্রতি যে কি অপরিসীম অপরাধ করিয়াছে সে কথাই তাহার মনে নাই। সেখানে বড় চাকরি ও হাতের দাগটাই তাহার সমস্ত স্থান জুড়িয়া বসিয়াছে! সেইখানে বসিয়া হঠাৎ ভারতীর চোখে পড়িল, সুমুখের খোলা জানালার ফাঁক দিয়া ভোরের আলো দেখা দিয়াছে। সেই মুহূর্ত্তে উঠিয়া নিঃশব্দে দ্বার খুলিল এবং কদর্য্য অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত স্থানে মাতালের নেশা কাটিয়া গেলে সে যেমন করিয়া মুখ ঢাকিয়া পলায়ন করে, ঠিক তেমনি করিয়া সে দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল।

১৮৫