পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 তাহার কথা শুনিয়া ডাক্তার হাসিয়া ফেলিলেন, বলিলেন, এবার কিন্তু বড় বোকার মত কথা হয়ে গেল ভারতী।

 ভারতী অপ্রতিভ চইল না, কহিল, তা জানি, কিন্তু এরা সবাই যে ভয়ঙ্কর নির্দ্দয়।

 আর আমি?

 তুমিও ভারি নিষ্ঠুর।

 সুমিত্রাকে কি রকম মনে হল ভারতী?

 এই প্রশ্ন শুনিয়া ভারতীর মাথা হেঁট হইয়া গেল। লজ্জায় উত্তর দিতে সে পারিল না, কিন্তু উত্তরের জন্য তাগিদও আসিল না। কিছুক্ষণের জন্য উভয়েই নীরব হইয়া রহিল। বেশিক্ষণ নয়, কিন্তু এইটুকু মাত্র মৌনতার অবকাশ পথ দিয়া এই অত্যাশ্চর্য্য মানুষটির ততোধিক আশ্চর্য্য হৃদয়ের রহস্যাবৃত তলদেশে অকস্মাৎ বিদ্যুৎ চমকিয়া গেল।

 কিন্তু পরক্ষণেই ডাক্তার সমস্ত ব্যাপারটাকে চাপা দিয়া ফেলিলেন। সহসা ছেলেমানুষের মত মাথা নাড়িয়া স্নিগ্ধস্বরে কহিলেন, অপূর্ব্বকে তুমি বড় অবিচার করেচ ভারতী। এতবড় মারাত্মক কাণ্ড এর ভেতর আছে সে বেচারা বোধ করি কল্পনাও করেনি। বাস্তবিক বলচি তোমাকে, এত ছোট, হীন সে কখনো নয়। চাকুরি করতে বিদেশে এসেছে, বাড়িতে মা আছে, ভাই আছে, দেশে বন্ধুবান্ধর আছে, সাংসারিক উন্নতি করে দশজনের একজন হবে এই তার আশা। লেখাপড়া শিখেচে, ভদ্রলোকের ছেলে, পরাধীনতার লজ্জা সে অনুভব করে। আরো দশজন বাঙালীর ছেলের মত সত্য সত্যই সে স্বদেশের কল্যাণ প্রার্থনা করে। তাই তুমি বললে যখন পথের দাবীর সভ্য হও, দেশের কাজ করো, সে বললে বহুৎ আচ্ছা! তোমার কথা শুনলে যে তার কখনো মন্দ হবে না এইটুকুই কেবল সে নিঃসংশৱে বোঝে। এই বিদেশে সকল আপদ-বিপদে তুমিই তার একমাত্র অবলম্বন। সেই তুমিই যে হঠাৎ তাকে মরণের মধ্যে ঠেলে দেবে সে তার কি জানতো বল?

 ভারতী অশ্রু গোপন করিতে মুখ নীচু করিয়া কহিল, কেন তুমি তার জন্যে এত ওকালতি কোরচ দাদা, তিনি তার যোগ্য নন। যে সব কথা তাঁর মুখ থেকে কাল শুনেচি, তারপরেও তাকে শ্রদ্ধা করা আর উচিত নয়।

 ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন, অনুচিত কাজই না হয় জীবনে একটা করলে। এই বলিয়া একটুখানি স্থির থাকিয়া কহিতে লাগিলেন, তুমি ত চোখে দেখনি, ভারতী, কিন্তু আমি দেখেচি। তারা যখন তাকে দড়ি দিয়ে বাঁধলে সে অবাক হয়ে রইল। তারা জিজ্ঞাসা করলে, তুমি এই সমস্ত বলেচ? সে ঘাড় নেড়ে বললে, হাঁ। তারা বললে, এর শাস্তি—তোমাকে মরতে হবে। প্রত্যুত্তরে সে কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে

১৮৮