পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আশ্রয় নিই। গাছতলার একটা বেঞ্চের উপর শুতে গিয়ে দেখি আর একজন শুয়ে আছে। মানুষের সাড়া পেয়ে সে জল জল করতে লাগলো, চারিদিকে ভয়ানক দুর্গন্ধ বেরিয়েছে,—দেশলাই জ্বেলে তার মুখের পানে তাকিয়েই বোঝা গেল, কলেরা। নীলকান্ত তার শুশ্রূষায় লেগে গেল। ফর্সা হয়ে আসে, বললাম, যোশী, লোকটা সন্ধ্যার অন্ধকারে যেমন করেই হোক পেয়াদাদের দৃষ্টি এড়িয়ে এই বাগানটায় রয়ে গেছে, কিন্তু সকালে তা হবে না। ওয়ারেণ্টের আসামী আমরা,—এ তো মরবেই, সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও যে যেতে হবে। চল, সরি! নীলকান্ত কাঁদতে লাগলো, বললে, এ অবস্থায় একে কি করে ফেলে যাবো ভাই— তার চেয়ে বরঞ্চ তুমি যাও, আমি অনেক বুঝালাম, কিন্তু যোশীকে নড়াতে পারলাম না।

 ভারতী সভয়ে কহিল, কি হ’ল তারপরে?

 ডাক্তার কহিলেন, লোটা বিবেচক ছিল, ভোর হবার পূর্ব্বেই চোখ বুঝলেন। তাই সে যাত্রায় নীলকান্তকে নড়াতে পারলাম। ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, সিঙ্গাপুরে যোশীর ফাঁসি হয়। পল্টনের সিপাইদের নাম বলে দিলে ফাঁসিটা তার মাপ হ’তো—গভর্ণমেণ্ট থেকে অনেক প্রকার চেষ্টাই হয়েছিল, কিন্তু যোশী সেই যে ঘাড় নেড়ে বললে, আমি জানিনে, তার আর বদল হ’ল না। অতএব, রাজার আইনে তার ফাঁসি হল। অথচ, যাদের জন্যে সে প্রাণ দিলে, তাদের সে ভাল করে চিনতও না। এখনও সেই সব ছেলে এদেশেই জন্মায় ভারতী, তা নইলে বাকী জীবনটা তোমার আঁচলের তলায় লুকিয়ে থাকতেই হয়ত রাজি হয়ে পড়তাম।

 প্রত্যুত্তরে ভারতী শুধু দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিল। ডাক্তার কহিলেন, নরহত্যা আমার ব্রত নয় ভাই, তোমাকে সত্যিই বলচি, ও আমি চাইনে।

 চাইতে না পারো, কিন্তু প্রয়োজন হলে?

 প্রয়োজন হলে? কিন্তু ব্রজেন্দ্রের প্রয়োজন এবং সব্যসাচীর প্রয়োজন ত এক নয় ভারতী!

 ভারতী বলিল, সে আমি জানি। আমি তোমার প্রয়োজনের কথাই জিজ্ঞাসা করচি দাদা।

 প্রশ্ন শুনিয়া ডাক্তার ক্ষণকাল চুপ করিয়া রহিলেন। মনে হইল যেন উত্তর দিতে তিনি দ্বিধা রোধ করিতেছেন। তাহার পরে কতকটা যেন অন্যমনস্কের মত ধীরে ধীরে বলিলেন, কে জানে কবে আমার সেই পরম প্রয়োজনের দিন আসবে! কিন্তু, থাক্ ভারতী, এ তুমি জানতে চেয়ো না। তার চেহারা তুমি কল্পনাতেও সইতে পারবে না, বোন।

১৯০