পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 মাঝি বলিল আচ্ছা দুটো পয়সা দাও, চল।

 ভারতী কহিল, না বাপু, তুমি যাও! বাড়ি আমার এপারে,ওপারে যাবার আমার দরকার নেই।

 মাঝি গেল না, একটু হাসিয়া কহিল, পয়সা না হয় নাই দেবে, চল তোমাকে একটু বেড়িয়ে নিয়ে আসি। এই বলিয়া সে ঘাটের একধারে নৌকা ভিড়াইতে উদ্যত হইল। ভারতী ভয় পাইল, গাছ-পালার মধ্যে স্থানটা অন্ধকার এবং নির্জ্জন। দীর্ঘদিন এদেশে থাকার জন্য ইহাদের ভাষা বলিতে না পারিলেও ভারতী বুঝিত। এবং ইহাও জানিত চট্টগ্রামের এই মুসলমান মাঝি সম্প্রদায় অতিশয় দুর্বৃত্ত। তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইয়া ক্রুদ্ধস্বরে কহিল, তুমি যাও বলচি এখান থেকে নইলে পুলিশ ডাকবো।

 তাহার উচ্চ কণ্ঠ ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাতে বোধ হয় চট্টগ্রামী মুসলমান এবার ভয় পাইয়া থামিল। ভারতী চাহিয়া দেখিল লোকটার বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ পার হইয়াছে, কিন্তু সখ যায় নাই। পরণে লতা-পাতা ফুল-কাটা লুঙ্গী, কিন্তু তেলে ও ময়লার অত্যন্ত মলিন। গায়ে মূল্যবান মিলিটারী ফ্রক কোট, জরির পাড়, কিন্তু যেমন নোংরা তেমনি জীর্ণ। বোধহয় কোন পুরাতন জামা-কাপড়ের দোকান হইতে কেনা। মাথায় বেলদার নেকড়ার টুপি, কপাল পর্য্যন্ত টানা। এই মূর্ত্তির প্রতি রোষদৃপ্তচক্ষে চাহিয়া ভারতী কয়েক মুহূর্ত্ত পরেই হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, দাদা, চেহারা যাই হোক, কিন্তু গলার আওয়াজটাকে পর্য্যন্ত বদলে মুসলমান করে ফেলেচ।

 মাঝি কহিল, যাবে, না পুলিশ ডাকবে?

 ভারতী কহিল, পুলিশ ডেকে তোমায় ধরিয়ে দেওয়াই উচিত। অপূর্ব্ববাবুর ইচ্ছেটা আর অপূর্ণ রাখি কেন!

 মাঝি কহিল, তার কথাই বলচি। এসো জোয়ার আর বেশি নেই, এখনো কোশ দুই যেতে হবে।

 ভারতী নৌকায় উঠিল, ঠেলিয়া দিয়া ডাক্তার পাকা মাঝির মতই দ্রুতবেগে অগ্রসর হইলেন। যেন দুইখানা দাঁড় টানাই তাঁহার পেশা। কহিলেন, লামা জাহাজ চলে গেল দেখলে?

 ভারতী কহিল, হ্যাঁ।

 ডাক্তার কহিলেন, অপূর্ব্ব এই দিকেই ফার্স্ট ক্লাস ডেকে দাঁড়িয়েছিল দেখতে পেলে?

 ভারতী ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, না।

১৯৪