পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ডাক্তার কহিলেন, তার বাসায় কিংবা আফিসে আমার যাবার জো ছিল না, তাই জেটির একধারে শাম্পান বেঁধে আমি ওপরে দাঁড়িয়েছিলাম। হাত তুলে সেলাম করতেই—

 ভারতী ব্যাকুল হইয়া কহিল, কার জন্যে কিসের জন্যে এতবড় ভয়ানক কাজ করতে গেলে দাদ? প্রাণটা কি তোমার একেবারেই ছেলেখেলা।

 ডাক্তার মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না একেবারেই না। আর গেলাম কিসের জন্যে? ঠিক সেইজন্যে যে জন্যে তুমি চুপটি করে এখানে একলা বসে আছ বোন।

 ভারতী উচ্ছ্বসিত ক্রন্দন কিছুতেই চাপিতে পারিল না। কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, কখ্‌খনো না। এখানে আমি এমনি এসেছি—প্রায় আসি। কারও জন্যে আমি কখ্‌খনো আসিনি। তোমাকে চিনতে পারলেন?

 ডাক্তার সহাস্যে বলিলেন, না, একেবারেই না। এ বিদ্যে আমার খুব ভাল করেই শেখা,—এ দাড়ি-গোঁফ ধরা সহজ কর্ম্ম নয়, কিন্তু আমার ভারি ইচ্ছে ছিল অপূর্ব্ববাবু যেন আমাকে চিনতে পারেন। কিন্তু এত ব্যস্ত যে তার সময় ছিল কই?

ভারতী নীরবে চাহিয়া ছিল, সেই অত্যন্ত উৎসুক মুখের প্রতি চাহিয়া ক্ষণকালের জন্য ডাক্তার নির্ব্বাক হইয়া গেলেন।

 ভারতী জিজ্ঞাসা করিল, তারপরে কি হ’ল।

 ডাক্তার বলিলেন, বিশেষ কিছুই না।

 ভারতী চেষ্টা করিয়া একটু হাসিয়া কহিল, বিশেষ কিছু যে হয়নি সে শুধু আমার ভাগ্য। চিনতে পারলেই তোমার ধরিয়ে দিতেন, আর সে অপমান এড়াবার জন্যে আমাকে আত্মহত্যা করতে হতো। চাকরি যাক, কিন্তু প্রাণটা বাঁচলো? এই বলিয়া সে দূর পরপারে দৃষ্টি প্রসারিত করিয়া নিশ্বাস মোচন করিল।

 ডাক্তার নীরবে নৌকা বাহিয়া চলিতে লাগিলেন।

 কিছুক্ষণ নিঃশব্দে থাকিয়া ভারতী সহসা মুখ তুলিয়া প্রশ্ন করিল, কি ভাবচ দাদা?

 বল ত দেখি?

 বলব? তুমি ভাবছো এই ভারতী মেয়েটি আমার চেয়ে ঢের বেশি মানুষ চিনতে পারে। নিজের প্রাণ বাঁচাতে কোন শিক্ষিত লোকই যে এত বড় হীনতা স্বীকার করতে পারে,—লজ্জা নেই, কৃতজ্ঞতা নেই, মায়াদয়া নেই,—খবর দিল না, খবর নেবার এতটুকু চেষ্টা করলে না,—ভয়ের তাড়নায় একেবারে জন্তুর মত ছুটে পালিয়ে গেল, এ কথা আমি কল্পনা করতেও পারিনি, কিন্তু ভারতী একেবারে নিঃসংশরে জেনেছিল। ঠিক এই না? সত্যি ব’লো।

১৯৫