পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পারিল, কিন্তু কথা বুঝিতে পারিল না, বুঝাইয়া দিল তেওয়ারী। কহিল, কে বললে আমাদের খাওয়া হয়নি। হয়ে গেছে, ও-সব তুমি নিয়ে যাও, বাবু শুনলে ভারি রাগ করবেন বলচি।

 অপূর্ব্ব নিঃশব্দে উঠিয়া আসিয়া দাঁড়াইল, কহিল, কি হয়েচে তেওয়ারী?

 মেয়েটি চৌকাঠের এদিকে ছিল তৎক্ষণাৎ সরিয়া গেল! তখন সেইমাত্র সন্ধ্যা হইয়াছে, আলো জ্বালা হয় নাই, সিঁড়ির দিক হইতে একটা অন্ধকার ছায়া ভিতরে আসিয়া পড়িয়াছে, তাহাতে মেয়েটিকে বেশ স্পষ্ট দেখা না গেলেও বুঝা গেল। তাহার রঙ ইংরাজদের মত সাদা নয়, কিন্তু খুব ফর্সা। বয়স উনিশ-কুড়ি কিম্বা কিছু বেশীও হইতে পারে, এবং একটু লম্বা বলিয়াই বোধ হয় কিছু রোগা দেখাইল। উপরের ঠোঁটের নীচে সুমুখের দাত দুটি একটু উঁচু মনে না হইলে মুখখানি বোধকরি ভালই। পায়ে চটি জুতা, পরণে চমৎকার একখানি মাদ্রাজী শাড়ি,—সম্ভবতঃ উৎসব বলিয়া,—কিন্তু ধরণটা কতক বাঙালী, কতক পার্শিদের মত। একটি জাপানী সাজিতে করিয়া কয়েকটি আপেল, নাসপাতি, গুটি-দুই বেদানা এবং এক গোছা আঙ্গুর সুমুখে মেজের উপর রহিয়াছে।

 অপূর্ব্ব কহিল, এ সব কেন?

 মেয়েটি বাহির হইতে ইংরাজিতে আস্তে আস্তে জবাব দিল, আজ আমাদের পর্ব্বদিন, মা পাঠিয়ে দিলেন। তা ছাড়া, আজ ত আপনাদের খাওয়া হয়নি।

 অপূর্ব্ব কহিল, আপনার মাকে ধন্যবাদ জানাবেন, কিন্তু আমাদের খাওয়া হয়ে গেছে।

 মেয়েটি চুপ করিয়া রহিল। অপূর্ব্ব জিজ্ঞাসা করিল, আমাদের খাওয়া হয়নি তাঁকে কে বললে?

 মেয়েটি লজ্জিতস্বরে কহিল, এই নিয়েই প্রথমে ঝগড়া হয়। তা ছাড়া আমরা জানি।

 অপূর্ব্ব মাথা নাড়িয়া কহিল, তাঁকে সহস্র ধন্যবাদ, কিন্তু সত্যই আমাদের খাওয়া হয়ে গেছে।

 মেয়েটি এক মুহূর্ত্ত মৌন থাকিয়া বলিল, তা বটে, কিন্তু সে ভাল হয়নি। আর এসব ত বাজারের ফল—এতে ত কোন দোষ নেই।

 অপূর্ব্ব বুঝিল তাহাকে কোনমতে শান্ত করিবার জন্য অপরিচিত এই রমণীর উদ্বেগের অবধি নাই। অল্পক্ষণ পূর্ব্বে সে লাঠি ও গলার শব্দে তাহার মেজাজের যে পরিচয় দিয়া আসিয়াছে, তাহাতে কাল সকালে যে কি হইবে এই ভাবিয়াই তাহাকে প্রসন্ন করিতেই ইহারা এই ভেট লইয়া উপস্থিত হইয়াছে। তাই সদয়কণ্ঠে

১৬