পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ভারতী ইহার জবাব দিল না, তেমনি মাথা নাড়িয়া আপত্তি জানাইয়া বলিল, না, আমাকে তুমি ফিরে রেখে এস।

 কিন্তু কিসের জন্য ভারতী? আমাকে কি তোমার বিশ্বাস হয় না?

 ভারতী অধোমুখে নিরুত্তর হইয়া রহিল।

 ডাক্তার কহিলেন, এমন কত রাত্রি ও তুমি একাকী অপূর্বর সঙ্গে কাটিয়েচ, সে কি আমার চেয়েও তোমার বেশি বিশ্বাসের পাত্র?

 ভারতী তেমনি নির্ব্বাক হইয়াই রহিল, হাঁ না কোন কথাই কহিল না। খালের ওই স্থানটা যেমন অন্ধকার তেমনি অপ্রশস্ত। দু’ধারের গাছের ডাল যাঝে মাঝে তাহার গায়ে আসিয়া ঠেকিতে লাগিল। এদিকে নদীতে ভাঁটার উল্টা টান গুরু হইয়া গেছে,—ডাক্তার খোলের মধ্যে হইতে লণ্ঠন বাহির করিয়া জ্বালিয়া সম্মুখে রাখিলেন এবং দাঁড় রাখিয়া দিয়া একটা সরু বাঁশ হাতে লইয়া ঠেলিতে ঠেলিতে বলিলেন, আজ যেখানে তোমাকে নিয়ে যাচ্চি ভারতী, দুনিয়ায় কেউ নেই সেখান থেকে তোমাকে উদ্ধার করতে পারে। কিন্তু আমার মনের কথা বুঝতে বোধ হয় তোমার আর বাকী নেই? এই বলিয়া তিনি হাঃ হাঃ করিয়া যেন জোর করিয়া হাসিতে লাগিলেন। অন্ধকারে তাঁহার মুখের চেহারা ভারতী দেখিতে পাইল না, কিন্তু তাঁহার হাসির স্বরে কে যেন অকস্মাৎ তাহার ভিতর হইতে তাহাকে ধিক্কার দিয়! উঠিল। মুখ তুলিয়া নিঃশঙ্ককণ্ঠে কহিল, তোমার মনের কথা বুঝতে পারি এত বুদ্ধি আমার নেই! কিন্তু তোমার চরিত্রকে আমি চিনি। একলা থাকা আমার উচিত নয় বলেই ওকথা বলেচি দাদা, আমাকে তুমি ক্ষমা কর।

 ডাক্তার ক্ষণকাল নিস্তব্ধ থাকিয়া স্বাভাবিক শান্ত কণ্ঠে কহিলেন, ভারতী, তোমাকে ছেড়ে যেতে আমার কষ্ট হয়। তুমি আমার বোন, আমার দিদি, আমার মা—এ বিশ্বাস নিজের ’পরে না থাকলে এ পথে আমি আসতাম না। কিন্তু তোমার মূল্য দিতে পারে এ সংসারে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। এর শতাংশের এক অংশও অপূর্ব্ব যদি কোনদিন বোঝে ত জীবনটা তার সার্থক হয়ে যাবে। দিদি, সংসারের মধ্যে তুমি ফিরে যাও,—আমাদের ভেতরে আর তুমি থেকো না। কেবল তোমার কথাটাই বলবার জন্যে আজ অপূর্ব্বর সঙ্গে আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম।

 ভারতী চুপ করিয়া রহিল। আজ একটা কথাও না বলিয়া অপূর্ব্ব চলিয়া গেছে। চাকরি করিতে বর্ম্মায় আসিয়াছিল, মাঝে ক’টা দিনেরই বা পরিচয়!

 সে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের ছেলে, তাহার দেশ আছে, সমাজ আছে, বাড়ি-ঘর আত্মীয়-স্বজন কত কি! আর অস্পৃহ ক্রীশ্চানের মেয়ে ভারতী। দেশ নাই, গৃহ নাই, মা-বাপ নাই, আপনার বলিতে কোথাও কেহ নাই। এ পরিচয় যদি আজ

১৯৭