পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হাত দুই পরিসর পথটুকু ছাড়া চারদিক কেয়া ও দেনো গাছের এমনি দুর্ভেদ্য জঙ্গলে ঘেরিয়া আছে যে, শুধু সাপ-খোপ বাঘ-ভালুক নয়, একপাল হাতী লুকাইয়া থাকিলেও দেখিবার জো নাই। ইহার ভিতরে যে মানুষ বাস করিতে পারে তাহা চোখে না দেখিলে কল্পনা করা অসম্ভব। কিন্তু এই লোকটির কাছে সকলই সম্ভব। ভাঙ্গা কাঠের সিঁড়ি ও দড়ি ধরিয়া উপরে উঠিতে একটি সাত-আট বছরের ছেলে আসিয়া যখন দ্বার খুলিয়া ছিল, তখন ভারতী বিস্ময়ে বাক্যহীন হইয়া রহিল। ভিতরে পা বাড়াইতেই দেখিতে পাইল মেঝের উপর চাটাই পাতিয়া শুইয়া একজন অল্পবয়স্কা বর্ম্মী স্ত্রীলোক, তিন-চারটি ছেলেমেয়ে যে যেখানে পড়িয়া, ইহাদেরই একজন ঘরের মধ্যে বোধ হয় একটা অপকর্ম্ম করিয়া রাখিয়াছে,—খুব সম্ভব অনাবশ্যক বোধেই তাহা পরিষ্কৃত হয় নাই—একটা দুঃসহ দুর্গন্ধে গৃহের বায়ুমণ্ডল বিষাক্ত হইয়া উঠিয়াছে। মেঝের সর্ব্বত্র ছড়ানো ভাত, মাছের কাঁটা এবং পিঁয়াজ-রসুনের খোলা, নিকটেই গোটা-দুই-তিন কালি-মাখা ছোট-বড় মাটির হাঁড়ি, ছেলেগুলো হাত ডুবাইয়া খাবলাইয়া ভাত-তরকারী খাইয়াছে তাহা চাহিলেই বুঝা যায়; ইহারই পাশ দিয়া ভারতী ডাক্তারের পিছু পিছু আর একটা ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইল। কোথাও কোন আসবাবের বালাই নাই, মেঝের উপর চাটাই পাতা, একধারে একটা সতরঞ্চি গুটান ছিল, ডাক্তার স্বহস্তে ঝাড়িয়া তাহা পাতিয়া দিয়া ভারতীকে বসিতে দিলেন। ভারতী নিঃশব্দে উপবেশন করিয়া দেখিল সেই পরিচিত প্রকাণ্ড বোঁচকাটি ডাক্তারের একপাশে রহিয়াছে। অর্থাৎ সত্য সত্যই ইঁহার এই ঘরটিই বর্ত্তমান বাসস্থান। ও-ঘর হইতে বর্ম্মী স্ত্রীলোকটি কি একটা জিজ্ঞাসা করিল, ডাক্তার বর্ম্মী ভাষাতেই তাহার জবাব দিলেন। অনতিকাল পরেই সেই ছেলেটা সানকিতে করিয়া দু-চাঙড় ভাত, পেয়ালায় ঝোল এবং পাতায় করিয়া খানিকটা মাছপোড়া আানিয়া একধারে রাখিয়া দিয়া গেল। নৌকার লণ্ঠনটি ডাক্তার সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলেন, তাহারই আলোকে এই সকল খাদ্যবস্তুর প্রতি চাহিবামাত্রই ভারতীর গা বমি-বমি করিয়া উঠিল।

 ডাক্তার কহিলেন, তোমারও বোধ হয় ক্ষিধে পেয়েচে, কিন্তু এ-সব—

 ভারতীর মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না, কিন্তু সে প্রবলবেগে মাথা নাড়িয়া জানাইল, না, না, কিছুতে না। সে ক্রীশ্চান মেয়ে, জাতিভেদ মানে না, কিন্তু যেখান হইতে যেভাবে এই সকল আনীত হইল তাহা ত সে আসিবার পথেই চোখে দেখিয়া আসিয়াছে।

 ডাক্তার কহিলেন, আমার কিন্তু ক্ষিদে পেয়েচে ভাই, আগে পেটটা ভরিয়ে নিই। এই বলিয়া তিনি হাত ধুইয়া স্মিতমুখে আহারে বসিয়া গেলেন। ভারতী

২০০