পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

চাহিয়া দেখিতেও পারিল না, ঘৃণায় ও অপরিসীম ব্যথায় মুখ ফিরাইয়া রহিল। তাহার বুকের ভিতর হইতে কান্না যেন সহস্রধারে ফাটিয়া পড়িতে চাহিল। হায়রে দেশ! হায়রে মুক্তির পিপাসা! জগতে কিছুই ইহারা আর আপনার বলিয়া অবশিষ্ট রাখে নাই। এই গৃহ, এই খাদ্য, এই ঘৃণিত সংশ্রব, এমনি করিয়া এই বন্য পশুর জীবনযাপন, ক্ষণকালের জন্য মৃত্যুও ভারতীর অনেক সুসহ বলিয়া মনে হইল। সে হয়ত অনেকেই পারে, কিন্তু এই যে দেহ-মনের অবিশ্রাম নির্য্যাতন, আপনাকে আপনি স্বেচ্ছায় পলে পলে এই যে হত্যা করিয়া চলার দুঃসহ সহিষ্ণুতা, স্বর্গে-মর্ত্যে কোথাও কি ইহার তুলনা আছে! অধীনতার বেদনা কি ইহাদের এ-জীবনের আর সমস্ত বেদনাবোধই একেবারে ধুইয়া দিয়াছে! কিছুই কোথাও বাকি নাই। তাহার অপূর্ব্বকে মনে পড়িল। তাহার চাকরির শোক, তাহার বন্ধু মহলে হাতের কালশিরার লজ্জা,—ইহারাই ত মাতার সহস্রকোটি সন্তান। ইহারাই ও দেশের মেরু-মজ্জা, খাইরা পরিয়া পাশ করিয়া, চাকরিতে কৃতকার্য্য হইয়া যাহাদের একটানা জীবন জন্ম হইতে মৃত্যু পর্য্যন্ত পরম নিরাপদে কাটিতেছে। আর ওই যে লোকটি একান্ত তৃপ্তিতে নির্ব্বিকার চিত্তে বসিয়া ভাত গিলিতেছে—ভারতীর মূহুর্ত্তের জন্য মনে হইল, হিমাচলের কাছে সহস্র খণ্ড উপলের তিলার্দ্ধ বেশি তাহারা নয়। আর তাহাদেরই একজনকে ভালবাসিয়া, তাহারই ঘরে গৃহণীপণার বঞ্চিত দুঃখে আজ সে বুক ফাটিয়া মরিতেছে। অকস্মাৎ ভারতী জোর করিয়া বলিয়া উঠিল, দাদা, তোমার নির্দ্দিষ্ট এই রক্তারক্তির পথ কিছুতেই ভাল নয়। অতীতের যত নজিরই তুমি দাও—যা অতীত, যা বিগত, সে-ই চিরদিন শুধু অনাগতের বুক চেপে তাকে নিয়ন্ত্রিত করবে, মানব-জীবনে এ বিধান কিছুতেই সত্য নয়। তোমার পথ নয়, কিন্তু তোমার এই সকল বিসর্জ্জন দেওয়া দেশের সেবাই আমি আজ থেকে মাথায় তুলে নিলাম। অপূর্ব্ববাবু সুখে থাকুন, তাঁর জন্যে আর আমি শোক করিনে, আমার বাঁচবার মন্ত্র আজ আমি চোখে দেখতে পেয়েছি।

 ডাক্তার সবিস্ময়ে মুখ তুলিয়া ভাতের ডেলার মধ্যে হইতে অস্ফুট কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, কি হ’ল ভারতী?

২০১