পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 কথা শুনিয়া ভারতী উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল, কহিল, তুমি কি তাহলে কালই চলে যাচ্ছো?

 ডাক্তার মৌন হইয়া রহিলেন। ভারতী মনে মনে বুঝিল ইহার আর পরিবর্ত্তন নাই। তারপরে এই রাত্রিটুকু অবসানের সঙ্গে সঙ্গেই এ দুনিয়ায় সে একেবারে একাকী। খোঁজ করিবারও কেহ থাকিবে না!

 ডাক্তার কহিতে লাগিলেন, হাঁটা-পথে আমাকে দক্ষিণ চীনের ক্যানটনের ভিতর দিয়ে এগোতে হবে। আর ও-পথে কর্ম্ম-সূত্রে যদি না আমেরিকার গিয়ে পড়ি ত প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলো ঘুরে আবার এই দেশেতেই এসে আশ্রয় নেব। তারপরে আগুন যদি না জ্বলে, আমি এইখানেই রইলাম ভারতী। একটুখানি হাসিয়া বলিলেন, আর ফিরতে যদি না-ই পারি বোন, বোধ হয় খবর একটা পাবেই।

 এই মানুষটির শান্তকণ্ঠের সহজ কথাগুলি কতই সামান্য, কিন্তু ইহার ভয়ঙ্কর চেহারা ভারতীর চোখের সম্মুখে ফুটিরা উঠিল। সে কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে থাকিয়া কহিল, হাঁটাপথে চীনদেশে যাওয়া যে কত ভয়ানক সে আমি শুনেচি। কিন্তু তুমি মনে মনে হেসো না দাদা, আমি তোমাকে ভয় দেখাতে চাইনি, কতটুকু তোমাকে আমি চিনি। কিন্তু, বেরিয়েই যদি যাও, এইখানেই আবার কেন ফিরে আসতে চাও? তোমার নিজের জন্মভূমিতে কি তোমার কাজ নেই?

 ডাক্তার কহিলেন, তাঁরই কাজের জন্যে আমি এদেশ ছেড়ে সহজে যাবো না। মেয়েরা এ দেশের স্বাধীন, স্বাধীনতার মর্ম্ম তারা বুঝবে। তাদের আমার বড় প্রয়োজন। আগুন যদি কখনো এদেশ জ্বলেছে দেখতে পাও, যেখানেই থাকো ভারতী, এই কথাটা আমার তখন স্মরণ ক’রো, এ আগুন মেয়েরাই জ্বেলেচে। কথাটা আমার মনে থাকবে ত?

 এই ইঙ্গিত ভারতী বুঝিল, কহিল, কিন্তু তোমার পথের পথিক ত আমি নই!

 ডাক্তার কহিলেন, তা আমি জানি। কিন্তু পথ তোমার যাই কেন না হোক, বড় ভাইয়ের কথাটা স্মরণ করতে ত দোষ নেই,—তবু ত দাদাকে মাঝে মাঝে মনে পড়বে!

 ভারতী কহিল, বড় ভাইকে মনে পড়বার আমার অনেক জিনিয় আছে। কিন্তু এমনি করেই বুঝি তোমার বিপথে মানুষকে তুমি টেনে আনো দাদা। আমাকে কিন্তু তা পারবে না। এই বলিয়া সহসা সে উঠিয়া পড়িল এবং গুটানো সতরঞ্চিটা ঝাড়িয়া পাতিয়া দিয়া বাঁশের আলনা হইতে কম্বল বালিশ প্রভৃতি পাড়িয়া লইয়া স্বহস্তে শয্যা রচনা করিতে আরম্ভ করিয়া দিয়া আস্তে আস্তে বলিল, অপূর্ব্ববাবুর জাহাজের চাকা আজ আমাকে যে পথের সন্ধান দিয়ে গেছে, এ জীবনে সেই আমার

২০৩