পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 হীরা সিং বলিল, সব আচ্ছা।

 আমিও যেতে পারি নাকি?

 হীরা কহিল, আপকো কঁহি যানা দুনিয়ামে কই রোক সক্‌তা? এই বলিয়া সে একটু হাসিল।

 বুঝা গেল পুলিশের লোক ভারতীর বাসার প্রতি নজর রাখিয়াছে ডাক্তারের যাওয়া নিরাপদ নয়।

 ভারতী হাত ছাড়িল না, চুপি চুপি কহিল, আমি যাবো না দাদা।

 কিন্তু তোমার ত পালিয়ে থাকবার দরকার নেই ভারতী।

 ভারতী তেমনি আস্তে আস্তে বলিল, দরকার থাকলেও আমি পালাতে পারবো না। কিন্তু এর সঙ্গে যাবো না।

 ডাক্তার আপত্তির কারণ বুঝিলেন। অপূর্ব্বর বিচারের দিন এই হীরা সিংই তাহাকে ভুলাইয়া লইয়া গিয়াছিল। একটু চিন্তা করিয়া কহিলেন, কিন্তু তুমি ত জানো ভারতী পাড়াটা কত খারাপ, এত রাত্রে একলা যাওয়া ত তোমার চলে না। আর আমি যে—

 ভারতী ব্যাকুলকণ্ঠে বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, না দাদা, তুমি আমাকে পৌঁছে দেবে, আমি ত এখনও পাগল হইনি যে—

 এই বলিয়া সে অসম্পূর্ণ কথার মাঝখানেই থামিয়া গেল। কিন্তু এত রাত্রে ও পাড়ায় একাকী যাওয়াও যে অসম্ভব, এ সত্যই বা তাহার চেয়ে বেশি কে জানিত? হাত ছাড়িয়া নৌকা হইতে নামিবার কিছুমাত্র লক্ষণ না দেখিয়া ডাক্তার স্নেহার্দ্রস্বরে আস্তে আস্তে বলিলেন, আমার ওখানে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে তোমাকে আমার নিজেরই লজ্জা করে। কিন্তু যাবে দিদি আর এক জায়গায়? আমাদের কবির ওখানে? সে নদীর ঠিক আর পারেই থাকে। যাবে?

 ভারতী জিজ্ঞাসা করিল, কবি কে দাদা?

 ডাক্তার কহিলেন, আমাদের ওস্তাদজী; বেহালা-বাজিয়ে,—

 ভারত খুশী হইয়া কহিল, তাঁকে কি ঘরে পাওয়া যাবে? আর মদ জুটে থাকে ত অজ্ঞান হয়েই হয়ত আছেন।

 ডাক্তার কহিলেন, আশ্চর্য্য নয়। কিন্তু আমার গলা শুনলেই তার নেশা কেটে যায়। তাছাড়া কাছেই নবতারা থাকেন—হয়ত তোমাকেও দুটো খাইয়ে দিতেও পারব।

 ভারতী ব্যস্ত হইয়া বলিল, রক্ষে কর দাদা, এই শেব রাত্রিতে আর আমাকে খাওয়াবার চেষ্টা করো না, কিন্তু তাই চলো যাই, সকাল হলেই আমরা ফিরে আসবো।

২১০