পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ভারতী রাগ করিয়া বলিল, না দাদা, এসব নোংরা কাজ তুমি বারণ করে দাও; নইলে আমি ওঁর ঘরে যাবো না।

 ডাক্তার কহিলেন, শুনচি ওদের শীঘ্র বিয়ে হবে।

 ভারতী ব্যাকুল হইয়া বলিল, বিয়ে হবে কি করে, এর যে স্বামী বেঁচে আছে?

 ডাক্তার কহিলেন, ভাগ্য হলে মরতে কতক্ষণ দিদি? শুনেচি ব্যাটা মরেচে দিন পনর হ’ল।

 ভারতী অতিশয় বিরক্তি সত্ত্বেও হাসিয়া ফেলিয়া কহিল, ও হয়ত মিছে কথা। তাছাড়া, এক বছর অন্ততঃ ওদের ত থামতেই হবে, নইলে সে যে ভারি বিশ্রী দেখাবে।

 তাহার উৎকণ্ঠা দেখিয়া ডাক্তার মুখ গম্ভীর করিয়া বলিলেন, বেশ, বলে দেখবো। তবে, থামলে বিশ্রী দেখাবে সেইটেই চিন্তার কথা।

 এই ইঙ্গিতের পরে ভারতী লজ্জায় নীরব হইয়া রহিল। সিঁড়িতে উঠিতে উঠিতে ডাক্তার চাপা গলায় বলিতে লাগিলেন, পাগলাটার জন্যেই কষ্ট হয়, শুনেচি ঐস্ত্রীলোকটাকে নাকি ও যথার্থই ভালবাসে। আর কাউকে যদি ভালবাসত। সহসা নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, কিন্তু সংসারের ভাল-মন্দের ফরমাস, বন্ধুগণের অভিরুচি,—এসব অতি তুচ্ছ কথা ভারতী! কেবল এইটুকু কামনা করি ওর ভালবাসার মধ্যে যদি সত্য থাকে ত সেই সত্যই যেন ওকে উদ্ধার করে দেয়।

 ভারতী চমকিয়া উঠিল। এবং তেমনি চাপাকণ্ঠেই সহসা প্রশ্ন করিয়া ফেলিল, সংসারে তা কি হয় দাদা?

 ডাক্তার অন্ধকারেই একবার মুখ ফিরিয়া চাহিলেন। তাহার পরে নিঃশব্দ পদে উঠিয়া গুণীর বদ্ধ দরজার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন।

 ডাক শুনিয়া বেহালা থামিল। খানিক পরে ভিতর হইতে দ্বার খুলিয়া শশিপদ বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল! ডাক্তারকে সে সহজেই চিনিল, কিন্তু আঁধারে ঠাওর করিয়া ভারতীকে চিনিতে পারিয়া একেবারে লাফাইয়া উঠিল,—অ্যাঁ? আপনি! ভারতী? আসুন, আসুন, আমার ঘরে আসুন। এই বলিয়া সে দুই হাত ধরিয়া তাহাকে ভিতরে লইয়া গেল। তাহার আনন্দদীপ্ত মুখের অকপট আহ্বানে, তাহার অকৃত্রিম উচ্ছ্বসিত সমাদরে ভারতীর সমস্ত ক্রোধ জল হইয়া গেল। শশী বিছানার কোন এক নিভৃত স্থান হইতে একটা খাম বাহির করিয়া ভারতীর হাতে দিয়া কহিল, খুলে পড়ুন। পরশু দশ হাজার টাকার ড্রাফট আসচে—নট্ এ পাই লেস্! বলতাম না? আমি জোচ্চর! আমি মিথ্যাবাদী। আমি মাতাল। কেমন, হল ত? দশ হাজার। নট্ এ পাই লেস্!

২১৪