পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বলিলেন, শশী, দিন-দুয়ের মধ্যে আমি যাচ্ছি হাঁটা-পথে চীনের মধ্য দিয়ে প্যাসিফিকের সব আইল্যাণ্ডগুলোই আর একবার ঘুরব। বোধ হয় জাপান আমেরিকাতেও যাবো। কবে ফিরবো জানিনে, ফিরবই কিনা তাই বা কে জানে, কিন্তু হঠাৎ যদি কখনো ফিরি শশী, তোমার বাড়িতে বোধহয় আমার স্থান হবে না?

 শশী ক্ষণকাল তাঁহার মুখের প্রতি নির্নিমেষ চক্ষে চাহিয়া রহিল, তাহার পরে তাহার নিজের মুখ ও কণ্ঠশব্দ আশ্চর্য্যরূপে পরিবর্ত্তিত হইয়া গেল। ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হবে। আমার বাড়িতে আপনার স্থান চিরকাল হবে।

 ডাক্তার কৌতুকভরে কহিলেন, সে কি কথা শশী, আমাকে স্থান দেওয়ার চেয়ে বড় বিপদ মানুষের আর আছে কি?

 শশী মূহূর্ত্ত চিন্তা না করিয়া বলিল, সে জানি, আমার জেল হবে। তা হোকগে! এই বলিয়া সে চুপ করিয়া রহিল। খানিক পরে ভারতীকে উদ্দেশ করিয়া ধীরে ধীরে বলিতে লাগিল, এমন বন্ধু আর নেই। ১৯১১ সালে জাপানের টোকিও সহরে বোমা ফেলার জন্যে যখন কোটোকুর সমস্ত দলবলের প্রাণদণ্ড হল, ডাক্তার তখন তার খবরের কাগজের ইংলিশ সাব-এডিটর। বাসার সুমুখের দিকটা পুলিশে ঘিরেচে, আমি কাঁদতে লাগলাম, উনি বললেন, মরলে চলবে না শশী, আমাদের পালাতে হবে। পিছনের জানালা থেকে দড়ি বেঁধে আমাকে নামিয়ে দিয়ে নিজেও নেমে পড়লেন,—ডাক্তারবাবু, উঃ—মনে আছে আপনার? এই বলিয়া সে বিগত স্মৃতির তাড়নায় কণ্টকিত হইয়া উঠিল।

 ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন, আছে বৈকি।

 শশী কহিল, থাকার ত কথা। কিন্তু আ-কিম সাহায্য না করলে সেবার ভবলীলা আমাদের সাঙ্গ হত ডাক্তারবাবু। সাংহাই বোটে আর পা দিতে হত না। উঃ—ঐ বেঁটে ব্যাটাদের মত বজ্জাত আর ভূ-ভারতে নেই? আমি ত আর সত্যিই আপনাদের বোমার দলে ছিলাম না—বাসায় থাকতাম, বেহালা শিখতাম। কিন্তু সে কি কথা শুনতো? শয়তান ব্যাটাদের না আছে আইন, না আছে আদালত। ধরতে পারলেই আমাকে ঠিক জবাই করে ছাড়ত। আজ যে এই কথা কইচি, চলেফিরে বেড়াচ্চি সে কেবল ওঁরই কৃপায়। এই বলিয়া সে চোখের ইঙ্গিতে তাহাকে দেখাইয়া দিল। কহিল, এমন বন্ধু দুনিয়ার নেই ভারতী, এমন দয়া-মায়াও সংসারে দেখিনি।

 ভারতীর চক্ষু সজল হইয়া উঠিল, কহিল, তোমার সমস্ত কাহিনী একদিন আমাদের গল্প করে শোনাও না দাদা। ভগবান তোমাকে এত বুদ্ধি দিয়েছিলেন,

২১৭