পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 অন্ধকারে ভারতী স্পষ্ট বুঝিতে পারিল দেশের বাহিরে, দেশের কাজে যে ছেলেটি লোকচক্ষুর অগোচরে নিঃশব্দে প্রাণ দিয়েচে তাহাকে স্মরণ করিয়া এই নির্ব্বিকার পরম সংযত মানুষটির গভীর হৃদয় ক্ষণিকের জন্য আলোড়িত হইয়া উঠিয়াছে। অকস্মাৎ যেন তিনি সোজা হইয়া উঠিয়া বসিলেন, বলিলেন, কি বলছিলে ভারতী, গোষ্পদ? তাই হবে হয়ত। কিন্তু যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জনপদ ভস্মসাৎ করে ফেলে, আয়তনে সে কতটুকু জানো? সহর যখন পোড়ে সে আপনার ইন্ধন আপনি সংগ্রহ করে দগ্ধ হয়। তার ছাই হবার উপকরণ তারই মধ্যে সঞ্চিত থাকে, বিশ্ব-বিধানের এ নিয়ম কোন রাজশক্তিই কোনদিন ব্যত্যয় করতে পারে না।

 ভারতী বলিল, দাদা, তোমার কথা শুনলে গা কাঁপে। রাজশক্তিকে তুমি দগ্ধ করতে চাও, তার ইন্ধন ত আমাদেরই দেশের লোক। এতবড় লঙ্কাকাণ্ডের কল্পনায় কি তোমার মনে করুণাও জাগে না?

 প্রত্যুত্তরে লেশমাত্র দ্বিধা নাই, ডাক্তার স্বচ্ছন্দে কহিলেন, না। প্রায়শ্চিত্ত কথাটা কি শুধু মুখেরই কথা? পূর্ব্ব পিতামহগণের যুগান্ত-সঞ্চিত পাপের অপরিমেয় স্তূপ নিঃশেষ হবে কিসে বলতে পারো? করুণার চেয়ে ন্যায়ধর্ম্ম ঢের বড় বস্তু ভারতী।

 ভারতী ব্যথা পাইয়া বলিল, এ তোমার সেই পুরানো কথা দাদা। ভারতের স্বাধীনতার প্রসঙ্গে তুমি যে কত নিষ্ঠুর হতে পারো তা যেন আমি ভাবতেই পারিনে। রক্তপাত ছাড়া আর কিছু যেন মনে তোমার জাগতেই পায় না! রক্তপাতের জবাব যদি রক্তপাতই হয়, তাহলে তারও ত জবাব রক্তপাত? এবং তারও ত জবাবে এই একই রক্তপাত ছাড়া আর কিছু মেলে না। এ প্রশ্নোত্তর ত সেই আদিম কাল থেকে হয়ে আসছে। তবে কি মানবের সভ্যতা এর চেয়ে বড় উত্তর কোনদিন দিতে পারবে না? দেশ গেছে, কিন্তু তার চেয়েও বড় সেই মানুষ ত আজও আছে। মানুষে মানুষে কি হানা-হানি না ক’রে কোন মতেই পাশাপাশি বাস করতে পারে না??

 ডাক্তার কহিলেন, ইংরাজের একজন বড় কবি বলেচেন, পশ্চিম ও পূর্ব্ব কোন দিন মিলতে মিশতে পারে না।

 ভারতী রুষ্ট হইয়া কহিল, ছাই কবি। বলুকগে সে। তুমি পরম জ্ঞানী, তোমাকে অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছি, আজও জিজ্ঞাসা করছি, হোক তারা পশ্চিমের, হোক তারা ইয়োরোপের মানুষ, কিন্তু তবু ও মানুষ? মানুষের সঙ্গে মানুষ কি কিছুতেই বন্ধুত্ব করতে পারে না? দাদা, আমি ক্রীশ্চান, ইংরাজের কাছে আমি বহু ঋণে ঋণী, তাদের অনেক সদ্‌গুণ আমি নিজের চোখে দেখেচি—তাদের এত মন্দ ভাবতে আমার বুকে শূল বেঁধে। কিন্তু আমাকে তুমি ভুল বুঝো না দাদা, আমি বাঙালী দরেরই মেয়ে,—

২৩৯