পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বাংলার মানুষ তোমার প্রাণাধিক প্রিয় না? এই বাঙলার দশ লক্ষ নর-নারী প্রতি বছর শুধু ম্যালেরিয়া জ্বরে মরে। এক একটা যুদ্ধ জাহাজের দাম জানো? এর একটার খরচে কেবল দশ লক্ষ মায়ের চোখের জল চিরদিনের তরে মোছানো যায়। ভেবেচ কখনো এ কথা? দেখেচ কখনো বুকের মধ্যে মায়ের মূর্ত্তি। শিল্প গেল, বাণিজা গেল, ধর্ম্ম গেল, জ্ঞান গেল, নদীর বুক বুজে মরুভূমি হয়ে উঠেচে, চাষা পেট পুরে খেতে পায় না, শিল্পী বিদেশীর দুয়ারে মজুরি করে,—দেশে জল নেই, অন্ন নেই, গৃহস্থের সর্ব্বোত্তম সম্পদ সে গোধন নেই,—দুধের অভাবে শিশুদের শুকিয়ে মরতে দেখেচ ভারতী?

 ভারতী চীৎকার করিয়া থামাইতে চাহিল, কিন্তু গলা দিয়া তাহার শুধু একটা অস্ফুট শব্দ বাহির হইল মাত্র।

 সব্যসাচীর সেই ধীর সংযত কণ্ঠস্বর কোন এক সময়ে অন্তর্হিত হইয়াছিল। বলিলেন, তুমি ক্রীশ্চান, মনে পড়ে একদিন কৌতূহলবশে ইয়োরোপের ক্রীশ্চান সভ্যতার স্বরূপ জানতে চেয়েছিলে। সেদিন ব্যথা দেবার ভয়ে বলিনি, কিন্তু আজ তার উত্তর দেব। তোমাদের কেতাবে কি আছে জানিনে, শুনেচি ভাল কথা ঢের আছে, কিন্তু বহুদিন এক সঙ্গে বসবাস করে এর সত্যকার চেহারা আর আমার এতটুকু অগোচর নেই। লজ্জাহীন উলঙ্গ স্বার্থ এবং পশু-শক্তির একান্ত প্রাধান্যই এর মূল মন্ত্র। সভ্যতার নাম দিয়ে দুর্ব্বল, অক্ষমের বিরুদ্ধে এতবড় মুষল মানুষের বুদ্ধি আর ইতিপূর্বে আবিষ্কার করেনি। পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে চেয়ে দেখ ইয়োরোপের বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা থেকে কোন দুর্ব্বল জাতিই আজ আর আত্মরক্ষা করতে পারেনি। দেশের মাটি, দেশের সম্পদ থেকে ছেলেরা বঞ্চিত হয়েচে কোন অপরাধে জানো ভারতী? একমাত্র শক্তিহীনতার অপরাধে। অথচ ন্যায়ধর্ম্মই সকলের বড় এবং বিজিতের অশেষ কল্যাণের জনেই এই স্বাধীনতার শৃঙ্খল তার পায়ে পরিয়ে সেই পঙ্গুর সর্ব্বপ্রকার দায়িত্ব বহন করাই ইয়োরোপীয় সভ্যতার চরম কর্ত্তব্য,—এই পরম অসত্য লেখায় বক্তৃতায় মিশনারির ধর্ম্মপ্রচারে ছেলেদের পাঠ্যপুস্তকে অবিশ্রান্ত প্রচার করাই তোমাদের ক্রীশ্চান সভ্যতার রাজনীতি।

 ভারতী মিশনারির হাতে মানুষ, অনেকের মহৎ চরিত্র সে যথার্থ-ই চোখে দেখিয়াছে; বিশেষতঃ তাহার ধর্ম্মবিশ্বাসের প্রতি এইরূপ অহেতুক আক্রমণে সে ব্যথা পাইয়া বলিল, দাদা, যে জন্যেই হোক তোমার শান্ত বুদ্ধি আজ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। ক্রীশ্চান ধর্ম্ম প্রচার করতে যাঁরা এদেশে এসেছেন তাঁদের সম্বন্ধে তোমার চেয়ে আমি ঢের বেশি জানি। তাঁদের প্রতি তুমি আজ নিরপেক্ষ সুবিচার করতে

২৪১