পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 তাহার ধর্ম্ম ও ধর্ম্মযাজকের প্রতি এই তীক্ষ্ণ ইঙ্গিতে ভারতী বিষণ্ণ হইয়া বলিল, এ কথা তোমার কাছে আমি পূর্ব্বেও শুনেছি, কিন্তু যে জাপানীদের তুমি ভক্তি করা তারা কি?

 ডাক্তার কহিলেন, ভক্তি করি? মিছে কথা। ওদের আমি ঘৃণা করি কোরিয়ানদের বার বার প্রতিশ্রুতি এবং অভয় দিয়েও বিনা দোষে মিথ্যা অজুহাতে তাদের রাজাকে বন্দী করে ১৯১০ সালে যখন কোরিয়া রাজ্য আত্মসাৎ করে নিল তখন আমি সাংহাইয়ে। সে দিনের সে সব অমানুষিক অত্যাচার ভোলবার নয়, ভারতী। আর অভয় কি শুধু একা জাপানই দিয়েছিল? ইয়োরোপও দিয়েছিল। শক্তিমানের বিরুদ্ধে ইংরাজ কথা কইলে না। এ্যাঙলো-জাপানী—সন্ধি-সূত্রে আমরা আবদ্ধ! এবং সেই কথাই আমেরিকা যুক্তরাজ্যের সভাপতি অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করে বললেন, প্রতিশ্রুতি তা কি। যে অক্ষম, শক্তিহীন জাতি আত্মরক্ষা করতে পারে না তাদের রাজ্য যাবে না ত যাবে কাদের? ঠিকই হয়েছে? এখন আমরা যাবো তাদের উদ্ধার করতে! অসম্ভব! পাগলামি! এই বলিয়া সব্যসাচী এক মুহূর্ত্ত মৌন থাকিয়া কহিলেন, আমিও বলি ভারতী,—অসম্ভব, অসঙ্গত, পাগলামি। প্রবল দুর্ব্বলের সম্পদ কেন ছিনিয়ে নেবে না, এ কথা যে সভ্য ইয়োরোপের নৈতিক-বুদ্ধি ভাবতেই পারে না।

 ভারতী নির্ব্বাক হইয়া রহিল। তিনি বলিতে লাগিলেন, আঠারো শতাব্দের শেষের দিকে ব্রিটিশ দূত লর্ড ম্যাকর্টনি এলেন চৈনিক দরবারে কিঞ্চিৎ ব্যবসার সুবিধে করে নিতে। মাঞ্চুরাজ শিন্‌লুঙ ছিলেন তখন সমস্ত চীনের সম্রাট, অত্যন্ত দয়ালু, দূতের বিনীত আবেদনে খুশী হয়ে আশীর্ব্বাদ করে বললেন, দেখ বাপু, আমাদের স্বর্গীয় সাম্রাজ্যে অভাব কিছুরই নেই, কিন্তু তুমি এসেচ অনেক দূর থেকে অনেক দুঃখ সয়ে। আচ্ছা ক্যানটন সহরে ব্যবসা কর, স্থান দিচ্ছি, তোমাদের ভাল হবে। রাজ-আশীর্ব্বাদ, নিষ্ফল হোলো না, ভালই হলো। পঞ্চাশ বছর পেরুল না চীনের সঙ্গে ইংরাজের প্রথম যুদ্ধ বাধলো।

 ভারতী বিস্মিত হইয়া কহিল, কেন দাদা?

 ডাক্তার কহিলেন, চীনেরই অন্যায়। বেয়াদপ হঠাৎ বলে বসলো, আফিঙ খেয়ে খেয়ে চোখ কান আমাদের বুঁজে গেল, বুদ্ধিশুদ্ধি আর নেই, দয়া করে জিনিসটার আমানি বন্ধ কর।

 তারপরে?

 তার পরের ইতিহাস খুব ছোট। বছর দুয়ের মধ্যে পুনশ্চ আফিঙ খেতে রাজি হয়ে, আরও পাঁচখানা বন্দরে শতকরা পাঁচটাকা মাত্র শুল্কে বাণিজ্যের মঞ্জুরি

২৪৪