পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 অপূর্ব্ব বলিল, গেল তা কি?

 তেওয়ারী ব্যাকুল হইয়া কহিল, বড়বাবুকে একটা তার করে দিই ছোটবাবু, তিনি না হয় এসে পড়ুন।

 তুই ক্ষেপলি তেওয়ারী! যা দেখ গে ওদিকে বুঝি সব পুড়ে-ঝুড়ে গেল। সাড়ে দশটায় আমাকে বেরোতে হবে। এই বলিয়া সে নিজের ঘরে চলিয়া গেল। তেওয়ারী রান্নাঘরে গিয়া প্রবেশ করিল, রাঁধা-বাড়ার কাজ হইতে বাবুর অফিসে যাওয়া পর্য্যন্ত যা কিছু সমস্তই তাহার কাছে একেবারে অর্থহীন হইয়া গেল। এবং যতই সে মনে মনে আপনাকে সমস্ত আপদের হেতু বলিয়া ধিক্কার দিতে লাগিল, ততই তাহার উদ্‌ভ্রান্ত চিত্ত এদেশের ম্লেচ্ছতার উপরে, গ্রহ নক্ষত্রের মন্দ দৃষ্টির উপরে পুরোহিতের গণনার ভ্রমের উপরে এবং সর্ব্বোপরি করুণাময়ীর অর্থলিপ্সার উপরে দোষ চাপাইয়া কোনমতে একটু সান্ত্বনা খুঁজিয়া ফিরিতে লাগিল।

 এমনিধারা মন লইয়াই তাহাকে রান্নার কাজ শেষ করিতে হইল। করুণাময়ীর হাতে গড়া মানুষ সে, অতএব মন তাহার যতই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাক, হাতের কাজে কোথাও ভুলচুক হইল না। যথাসময়ে আহারে বসিয়া অপূর্ব্ব তাহাকে সাহস দিবার অভিপ্রায়ে রন্ধনের কিছু বাড়াবাড়ি প্রশংসা করিল। একদফা অন্নব্যঞ্জনের চেহারার যশোকীর্ত্তন করিল, এবং দুই এক গ্রাস মুখে পুরিয়াই কহিল, আজ রেঁধেচিস্ যেন অমৃত তেওয়ারী। ক’দিন খাইনি, ভেবেছিলাম বুঝি বা সব পুড়িয়ে-ঝুড়িয়ে ফেলবি! যে ভীতু লোক তুই—আচ্ছা মানুষটিকে মা বেছে বেছে সঙ্গে দিয়েছিলেন।

 তেওয়ারী কহিল, হুঁ।

 অপূর্ব্ব তাহার প্রতি চাহিয়া সহাস্যে কহিল, মুখখানা যে একেবারে তোলো হাঁড়ি করে রেখেছিল রে? এবং শুধু কেবল তেওয়ারীর নয়, নিজের মন হইতেও ব্যাপারটা লঘু করিয়া দিবার চেষ্টায় কৌতুক করিয়া বলিল, হারামজাদা ফিরিঙ্গির শাসানোর ঘটাটা একবার দেখলি? পুলিশে যাচ্চেন!—আরে, যা না তাই। গিয়ে করবি কি শুনি? তোর সাক্ষী আছে?

 তেওয়ারী শুধু কহিল, সাহেব-মেমদের কি সাক্ষী-সাবুদ লাগে বাবু, ওরা বললেই হয়।

 অপূর্ব্ব কহিল, হাঁ বললেই হয়! আইন-কাহন যেন নেই! তাছাড়া, ওরা আবার কিসের সাহেব-মেম? রঙটি তো একেবারে আমার-বার্নিস করা জুতো! ব্যাটা কচি ছেলেকে যেন জুজুর ভয় দেখিয়ে গেল! নচ্ছার পাজি হারামজাদা!

 তেওয়ারী চুপ করিয়া রহিল। আড়ালে গালি-গালাজ করিবার মত তেজও আর তাহার ছিল না।

২১