পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

করিয়া লজ্জিত হইয়া বলিল, তোমার দুষ্টুমির জ্বালায় না হেসে পারা যায় না, কিন্তু এ তোমার ভারি অন্যায়। তার পরে পেট পুরে খেয়ে দেয়ে টাকার থলিটিও নিয়ে চলে যাবে না কি?

 ডাক্তার মুখের গ্রাস গিলিয়া লইয়া কহিলেন, নিশ্চয় নিশ্চয়, অর্দ্ধেকটা ত গেছে নবতারার বাড়ি তৈরীর খাতায়, বাকীটা কি রেখে যাবো আহমেদ-আবদুল্লা সাহেবের গাড়ি-জুড়ি কিনতে? তামাসা সর্ব্বাঙ্গসুন্দর করতে নেহাৎ মন্দ পরামর্শ দাওনি ভারতী। কি বল শশী? হাঃ হাঃ হাঃ—

 ভারতী বলিল, দাদা, তোমাকে হাসি-ঠাট্টা করতে আগেও দেখেচি বটে, কিন্তু এমন ক্ষ্যাপার মত হাসতে আর কখনো দেখিনি।

 ডাক্তার জবাব দিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু ভারতীর মুখের প্রতি চাহিয়া সহসা কিছু বলিতে পারিলেন না। ভারতী পুনশ্চ কহিল, নর-নারীর ভালবাসা কি তোমারি মত সকলের উপহাসের বস্তু যে, তাসের ছক্কা-পাঞ্জা হারার মত এর হারজিতে অট্টহাসি করা ছাড়া আর কিছুই করবার নাই? স্বাধীনতা পরাধীনতা ছাড়া মানুষের ব্যথা পাবার কি দুনিয়ায় কিছুই তুমি ভাবতে পারবে না! দেখ ত একবার শশীবাবুর মুখের দিকে চেয়ে। একটা বেলার মধ্যে উনি কি হয়ে গেছেন। অপূর্ব্বরাবু যখন চলে গেলেন সেদিন আমাকে উপলক্ষ্য করেও হয়ত তুমি এমনি করেই হেসেচ।

 না, না, সে হ’ল—

 ভারতী বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, না না বলচো কিসের জন্য দাদা? শশীবাবু তোমার স্নেহের পাত্র, তুমি এই ভেবে খুশী হয়ে উঠেচ যে, নির্ব্বোধ তাঁকে ফাঁদের মধ্যে ফেলে নবতারা অনেক দুঃখ দিত। ভবিষ্যতের সেই দুঃখের হাত থেকে তিনি এড়িয়ে গেলেন। কিন্তু ভবিষ্যতই কি মানুষের সব? আজকের এই একটিমাত্র দিন যে ব্যথার ভারে তাঁর সমস্ত ভবিষ্যৎকে ডিঙিয়ে গেল এ তুমি কি করে জানবে বল? তুমি ত কখনো ভালবাসোনি!

 শশী অতিশয় অপ্রতিভ হইয়া পড়িল। সে কোন মতে বলিতে চাহিল যে তাহারই অন্যায়, তাহারই ভুল, সাংসারিক সাধারণ বুদ্ধি না থাকার জন্যই—

 ভারতী ব্যগ্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, লজ্জা কিসের শশীবাবু? এ ভুল কি সংসারে একা আপনিই করেচেন? আপনার শতগুণ ভুল আমি করিনি? তারও সহস্রগুণ বেশি ভুল করে যে দুর্ভাগিনী নিঃশব্দে এ দেশ ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যেতে উদ্যত হয়েছে, তাকে কি ডাক্তার চেনেন না? নবতারা ঠকিয়েছে? ঠকাক না। তবু ত আমাদেরই বঞ্চনার গান গেয়ে জগতের অর্দ্ধেক কাব্য অমর হয়ে আছে।

২৫০