পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

একবার সজল চক্ষে বলতে পারলে না যে, ভগবান! আমি কারও মন্দ চাই কিন্তু তুমি সত্যির যদি হও ত এর বিচার কোরো?

 ভারতীর মুখ দিয়া দীর্ঘনিশ্বাস বাহির হইয়া আসিল, তাই তোমার এত স্নেহ।

 ডাক্তার বলিলেন, শুধু স্নেহ নয়, শ্রদ্ধা। শশী সাধু লোক, সমস্ত অন্তরখানি যেন গঙ্গাজলের মত শুদ্ধ নির্ম্মল। ভারতী, আমি চলে গেলে বোন, একে একটু দেখো। তোমার হাতেই শশীকে আমি দিয়ে গেলাম, ও দুঃখ পাবে, কিন্তু দুঃখ কখনো কাউকে দেবে না।

 শশী লজ্জা ও কুণ্ঠায় আরক্ত হইয়া উঠিল। ইহার কিছু পরে কিছুক্ষণ পর্য্যন্ত বোধ করি কথার অভাবেই তিনজনেই নীরব হইয়া রহিলেন।

 ডাক্তার জিজ্ঞাসা করিলেন, কিন্তু এখন থেকে কি করবে কবি? তোমার বাকী রইল ত কেবল ওই বেহালাখানি। আগের মত আবার দেশে দেশে বাজিয়ে বেড়াবে?

 এবার শশী হাসিমুখেই বলিল, আপনার কাজে আমাকে ভর্ত্তি করে নিন,— বাস্তবিকই আমি আর মদ খাবো না।

 তাহার কথা এবং কথা বলার ভঙ্গি দেখিয়া ভারতী হাসিল। ডাক্তার নিজেও হাসিলেন, স্নেহার্দ্রকণ্ঠে কহিলেন, না কবি, ওতে তোমার আর ভর্ত্তি হয়ে কাজ নেই। তুমি আমার এই বোনটির কাছে থেকো, তাতেই আমার ঢের বড় কাজ হবে।

 শশী মাথা নাড়িয়া সম্মতি জানাইল। এক মুহূর্ত্ত মৌন থাকিয়া সঙ্কোচের সহিত কহিল, আগে আমি কবিতা লিখতে পারতাম ডাক্তার—হয়ত এখনও পারি।

 ডাক্তার খুশী হইয়া কহিলেন, তাও বটে! আর তাতেই যে আমার মস্ত কাজ হবে কবি।

 শশী কহিল, আমি আবার আরম্ভ করব! চাষাভূষা, কুলি-মজুরদের জন্যেই এবার শুধু লিখব।

 কিন্তু তারা ত পড়তে জানে না কবি?

 শশী কহিল, নাই জানলে, তবু তাদের জন্যেই আমি লিখবো।

 ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন, সেটা অস্বাভাবিক হবে এবং অস্বাভাবিক জিনিস টিকবে না। অশিক্ষিতের জন্যে অন্নসত্র খোলা যেতে পারে, কারণ, তাদের ক্ষুধাবোধ আছে কিন্তু সাহিত্য পরিবেশন করা যাবে না। তাদের সুখ-দুঃখের বর্ণনা করার মানেই তাদের সাহিত্য নয়। কোনদিন যদি সম্ভব হয়, তাদের সাহিত্য তারাই

২৫৫