পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আর নিজেকে গোপন করে যেয়ো না—তোমার, আমার, সকলের যা পরম সত্য তাই আজ অকপটে প্রকাশ কর।

 এই অদ্ভূত অনুনয়ের অর্থ না বুঝিয়া শশী ও সুমিত্রা উভয়েই বিস্ময়ে চাহিয়া রহিল এবং তাহাদেরই উৎসুক চোখের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া ভারতী নিজের ব্যাকুলতায় নিজেই লজ্জিত হইয়া উঠিল। এই লজ্জা ডাক্তারের দৃষ্টি এড়াইল না। তিনি সহাস্যে কহিলেন, সত্য, মিথ্যা এবং সত্য-মিথ্যায় জড়িয়ে ত সবাই বলে ভারতী, আমার আর বিশেষ দোষ হ’ল কি? তাছাড়া লজ্জা যদি পাবার থাকে ত সে আমার, কিন্তু লজ্জা পেলে যে তুমি!

 ভারতী নত মুখে নীরব হইয়া রহিল। সুমিত্রা ইহার জবাব দিয়া কহিল, লজ্জা যদি তোমারই না-ই থাকে ডাক্তার! কিন্তু মেয়েরা সত্যি কথাটাও মুখের উপর স্পষ্ট করে বলতে লজ্জা বোধ করে। কেউ কেউ বলতেই পারে না।

 এই মন্তব্যটি যে কাহাকে উদ্দেশ্য করিয়া কিসের জন্য বলা হইল তাহা বুঝিতে কাহারও বাকী রহিল না, কি যে শ্রদ্ধা ও সম্মান তাঁহার প্রাপ্য বোধ হয় তাহাই অপর সকলকে নিরুত্তর করিয়া রাখিল। মিনিট দুই-তিন এমনি নিঃশব্দে কাটিলে ডাক্তার ভারতীকে পুনরায় লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, ভারতী, সুমিত্রা বললেন, আমার লজ্জা নেই, তুমি দোষ দিলে আমি সুবিধামত সত্য ও মিথ্যা দুই-ই বলি। আজও তেমনি কিছু বলেই এ প্রসঙ্গ শেষ করে দিতে পারতাম, যদি না এর সঙ্গে আমার পথের দাবীর সম্বন্ধ থাকতো। এর ভাল-মন্দ দিয়েই আমার সত্য-মিথ্যা নির্দ্ধারিত হয়। এই আমার নীতিশাস্ত্র, এই আমার অকপট মূর্ত্তি!

 ভারতী অবাক হইয়া কহিল, বল কি দাদা, এই তোমার নীতি, এই তোমার অকপট মূর্ত্তি?

 সুমিত্রা বলিয়া উঠিল, হাঁ, ঠিক এই! এই ওঁর যথার্থ স্বরূপ। দয়া নেই, মায়া নেই, ধর্ম্ম নেই—এই পাষাণ মূর্ত্তি আমি চিনি ভারতী।

 তাঁহার কথাগুলা যে ভারতী বিশ্বাস করিল তাহা নয়, কিন্তু সে স্তব্ধ হইয়া রহিল।

 ডাক্তার কহিলেন, তোমরা বল চরম সত্য, পরম সত্য—এই অর্থহীন নিষ্ফল শব্দগুলো তোমাদের কাছে মহা মূল্যবান। মূর্খ ভোলাবার এতবড় যাদুমন্ত্র আর নেই। তোমরা ভাবো মিথ্যাকেই বানাতে হয়, সত্য, শাশ্বত, সনাতন, অপৌরুষেয়? মিছে কথা। মিথ্যার মতই একে মানব-জাতি অহরহ সৃষ্টি করে চলে। শাশ্বত; সনাতন নয়,—এর জন্ম আছে, মৃত্যু আছে। আমি মিথ্যা বলিনে, আমি প্রয়োজনে সত্য সৃষ্টি করি।

২৬০