পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 সুমিত্রার দুই চক্ষে কৃতজ্ঞতা উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। মুখে সে কিছুই বলিল না, কিন্তু তাহার সর্ব্বাঙ্গ দিয়া এই কথাটাই ফুটিয়া বাহির হইল, সবই ত তোমার, কিন্তু সে কি তুমি ছোঁবে?

 ডাক্তার দৃষ্টি অপসারিত করিয়া কয়েক মুহূর্ত্ত স্তব্ধভাবে থাকিয়া ডাকিলেন, কবি!

 বলুন।

 ব্রাহ্মণ ভোজনটা একটু আগাম সেরে নিলাম বলে তুমি দুঃখ ক’রো না। কারণ, শুভক্ষণ যখন সত্যি এসে পৌঁছবে তখন দ্বিতীয়বার আর আমি ফুরসৎ পাবো না। কিন্তু সেদিন আসবে। নানাবিধ সুখাদ্যে পরিতৃপ্ত হয়ে আজ তোমাকে বর দিলাম, তুমি সুখী হবে। কিন্তু দুটি কাজ তুমি কখনো ক’রো না। মদ খেয়ো না, আর রাজনীতিক বিপ্লবের মধ্যে যেয়ো না। তুমি কবি, তুমি দেশের বড় শিল্পী—রাজনীতির চেয়ে তুমি বড় এ কথা ভুলো না।

 শশী ক্ষুণ্ণ হইয়া কহিল, আপনি যাতে আছেন, আমি তার মধ্যে থাকলে দোষ হবে,—আমি কি আপনার চেয়েও বড়?

 ডাক্তার কহিলেন, বড় বই কি! তোমার পরিচয়ই ত জাতির সত্যকার পরিচয়। তোমরা ছাড়া এর ওজন হবে কি দিয়ে? একদিন এই স্বাধীনতা-পরাধীনতার সমস্যার মীমাংসা হবেই,—এর দুঃখ-দৈনন্দিন কাহিনী সেদিন জনশ্রুতির অধিক মূল্য পাবে না, কিন্তু তোমার কাজের মূল্য নিরূপণ করবে কে? তুমিই ত দিয়ে যাবে দেশের সমস্ত বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত ধারাকে মালার মত গেঁথে।

 সুমিত্রা মৃদুহাস্যে বলিল, কবে গাঁথবেন সে উনিই জানেন, কিন্তু তুমি কথা গেঁথে গেঁথে যে মূল্য ওঁর এখনি বাড়িয়ে দিলে, ভারতী সামলাবে কি করে?

 শুনিয়া সবাই হাসিল, ডাক্তার কহিলেন, শশী হবে আমাদের জাতীয় কবি। হিন্দুর নয়, মুসলমানের নয়, খ্রীষ্টানের নয়,—শুধু আমার বাঙলা দেশের কবি। সহস্র নদ-নদী প্রবাহিত আমার বাঙলা দেশ, আমার সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা মাঠের পরে মাঠে-ভরা বাঙলা দেশ। মিথ্যা রোগের দুঃখ নেই, মিথ্যা দুর্ভিক্ষের ক্ষুধা নেই, বিদেশী শাসনের সুদুঃসহ অপমানের জ্বালা নেই, মনুষত্বহীনতার লাঞ্ছনা নেই,—তুমি হবে শশী, তারই চারণ কবি, পারবে না ভাই?

 ভারতীর সর্ব্বাঙ্গ কণ্টকিত হইয়া উঠিল, শশী ভ্রাতৃ সম্বোধনের মাধুর্য্যে বিগলিত হইয়া বলিল, ডাক্তার, চেষ্টা করলে আমি ইংরাজিতেও কবিতা লিখতে পারি। এমন কি—

 ডাক্তার বাধা দিয়া বলিয়া উঠিলেন, না না, ইংরাজি নয়, ইংরাজি নয়,—শুধু বাঙলা, শুধু এই সাত কোটি লোকের মাতৃভাষা। শশী, পৃথিবীর প্রায় সকল ভাষাই

২৬২