পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আমি জানি, কিন্তু সহস্র দলে বিকশিত এমন মধু দিয়ে ভরা ভাষা আর নেই! আমি অনেক সময় ভাবি ভারতী, এমন অমৃত এদেশে কবে কে এনেছিল?

 ভারতীর চোখের কোণে জল আসিয়া পড়িল, সে কহিল, আর আমি ভাবি দাদা, দেশকে এতখানি ভালবাসতে তোমাকে কে শিখিয়েছিল। কোথাও যেন এর আর সীমা নেই!

 ইহাই প্রতিধ্বনি তুলিয়া শশী উচ্ছ্বসিত স্বরে বলিয়া উঠিল, এই বিগত গৌরবের গানই হবে আমার গান, এই ভালবাসার সুরই হবে আমার সুর। নিজের দেশকে বাঙলা দেশের লোকে যেন আবার তেমনি করে ভালবাসতে পারে—এই শিক্ষাই হবে আমার শিক্ষা দেওয়া।

 ডাক্তার বিস্মিত চোখে মুহূর্ত্তকাল শশীর প্রতি চাহিয়া সুমিত্রার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া অবশেষে উভয়েই হাসিলেন। কিন্তু এই মর্ম্ম অপর দুই জনে উপলব্ধি না করিতে পারিয়া দুই জনেই অপ্রতিভ হইয়া পড়িল। ডাক্তার কহিলেন, আবার তেমনি করে ভালবাসবে কি? তুমি যে ভালবাসার ইঙ্গিত করচ শশী, সে ভালবাসা বাঙালী কস্মিনকালে বাঙলা দেশকে বাসেনি। তার তিলার্ব্ধ থাকলেও কি বাঙালী বিদেশীর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে এই সাত কোটি ভাইবোনকে অবলীলাক্রমে পরের হাতে সঁপে দিতে পারতো? জননী জন্মভূমি ছিল শুধু কথার কথা? মুসলমান বাদশার পায়ের তলায় অঞ্জলি দেবার জন্যে হিন্দু মানসিংহ হিন্দু প্রতাপাদিত্যকে জানোয়ারের মত করে বেঁধে নিয়ে গিয়েছিল। আর তাকে রসদ যুগিয়ে পথ দেখিয়ে এনেছিল বাঙালী। বর্গীরা দেশ লুট করতে আসত, বাঙালী লড়াই করত না, মাথায় হাঁড়ি দিয়ে জলে বসে থাকতো। মুসলমান দস্যুরা মন্দির ধ্বংস করে দেবতাদের নাক কান কেটে দিয়ে যেতো, বাঙালী ছুটে পালাত, ধর্ম্মের জন্য গলা দিত না। সে বাঙালী আমাদের কেউ নয়, কবি, গৌরব করার মত তাদের কিছু ছিল না। তাদের আমরা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে চলবো—তাদের ধর্ম্ম, তাদের অনুশাসন, তাদের ভীরুতা, তাদের দেশদ্রোহিতা, তাদের সামাজিক রীতিনীতি,—তাদের যা কিছু সমস্ত। সেই ত হবে তোমার বিপ্লবের গান, সেই ত হবে তোমার দেশ-প্রেম!

 শশী বিমূঢ়ের মত চাহিয়া রহিল, এই উক্তির মর্ম্ম গ্রহণ করিতে পারিল না।

 ডাক্তার বলিতে লাগিলেন, তাদের কাপুরুষতায় আমরা বিশ্বের কাছে হেয়, স্বার্থপরতার ভারে দায়গ্রস্ত, পঙ্গু! শুধু কি কেবল দেশ? যে ধর্ম্ম তারা আপনারা মানতো না, যে দেবতাদের ’পরে তাদের নিজেদের আস্থা ছিল না, তাদেরই দোহাই দিয়ে সমস্ত জাতির আপাদ-মস্তক যুক্তিহীন বিধি-নিষেধের সহস্র পাকে বেঁধে দিয়ে গেছে।

২৬৩