পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 শশী খুশী না হইলেও এই ব্যবস্থায় রাজি হইল। সমস্ত জিনিসপত্র সমেত দাদাঠাকুরের হোটেলের মধ্যে কবিকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া ভারতী যখন ফিরিয়া আসিল তখন রাত্রি হইয়াছে। আজ সকল দিক দিয়া তাহার শ্রান্তি ও চিন্তার আর অবধি ছিল না, পাছে শশী কিংবা আর কেহ আসিয়া তাহার নিঃসঙ্গ স্তব্ধতায় বিঘ্ন ঘটায়, এই আশঙ্কায় সে নীচের ও উপরের সমস্ত দরজা-জানালা রুদ্ধ করিয়া দিয়া নিজের শোবার ঘরে প্রবেশ করিল।

 অভ্যাস মত পরদিন প্রত্যুষে যখন তাহার ঘুম ভাঙ্গিল তখন অনাহারের দুর্ব্বলতায় সমস্ত শরীর এমনি অবসন্ন যে শয্যা ত্যাগ করিতেও ক্লেশ বোধ হইল। তৃষ্ণায় বুকের মধ্যেটা শুকাইয়া মরুভূমি হইয়া উঠিয়াছে, সুতরাং দেহধারণের এ দিকটায় অবহেলা করিলে আর চলিবে না, তাহা সে বুঝিল।

 খ্রীষ্টধর্ম্ম অবলম্বন করিয়াও যে ভারতী খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে সত্যই বাচ-বিচার করিয়া চলিত, এ কথা বলিলে তাহার প্রতি অবিচার করা হয়। তথাপি, মনে হয় সে সম্পূর্ণ সংস্কারমুক্ত হইতেও পারে নাই। যে ব্যক্তিকে তাহার জননী বিবাহ করিয়াছিলেন, সে অত্যন্ত অনাচারী ছিল, তাহার সহিত একত্রে বসিয়াই ভারতীকে ভোজন করিতে হইত, তাই বলিয়া পূর্ব্বেকার দিনের অখাদ্য বস্তু কোনদিনও তাহার খাদ্য হইয়া ওঠে নাই। ছোঁওয়া-ছুঁইর বিড়ম্বনা তাহার ছিল না। কিন্তু যেখানে-সেখানে যাহার-তাহার হাতে খাইতেও তাহার অত্যন্ত ঘৃণা বোধ হইত। মায়ের মৃত্যুর পর হইতে সে খরচের দোহাই দিয়া বরাবর নিজে রাঁধিয়াই খাইত। শুধু অসুস্থ হইয়া পড়িলে বা কাজের ভিড়ে অতিশয় ক্লান্তি বা একান্ত সময়াভাব ঘটিলেই, কদাচিৎ কখনও ঠাকুর মহাশয়ের হোটেল হইতে সাগু, বার্লি, রুটি আনাইয়া খাইত। বিছানা হইতে উঠিয়া সে হাত-মুখ ধুইয়া কাপড় ছাড়িয়া অন্যান্য দিনের ন্যায় প্রস্তুত হইল, কিন্তু রান্না করিয়া লইবার মত জোর বা প্রবৃত্তি আজ তাহার ছিল না, তাই হোটেল হইতে রুটি ও কিছু তরকারী তৈরী করিয়া দিবার জন্য ঠাকুর মহাশয়কে খবর পাঠাইল। সোমবারে তাহাদের পাঠশালা বন্ধ থাকিত বলিয়া আজ এ দিকের পরিশ্রম তাহার ছিল না।

 অনেক বেলায় ঝি খাবারের থালা হাতে করিয়া আনিয়া অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া কহিল, বড্ড বেলা হয়ে গেল দিদিমণি—

 ভারতী তাহার নিজের থালা ও বাটি আনিয়া টেবিলের উপরে রাখিল। হিন্দু হোটেলের শুচিতা রক্ষা করিয়া ঝি দূর হইতে সেই পাত্রে রুটি ও তরকারী এবং বাটিতে ডাল ঢালিয়া দিতে দিতে কহিল, নাও বোসো, যা পারো দুটো মুখে দাও।

 ভারতী তাহার মুখের প্রতি একবার চাহিয়া দেখিল, কিছু বলিল না। ঝির

২৭১