পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বক্তব্য তখনও শেষ হয় নাই, সে বলিতে লাগিল, ওখান থেকে ফিরে এসে শুনি তোমার অসুখ। একলা হাতে তখন থেকে ধড়ফড় করে মরচি দিদিমণি, কিন্তু এমন কেউ নেই যে দুখানা রুটি বেলে দেয়। আর দেরি ক’রো না, বোসো।

 ভারতী মৃদুকণ্ঠে কহিল, তুমি যাও ঝি, আমি বসচি।

 ঝি কহিল, যাই। চাকরটা ত সঙ্গে গেল, একলা সমস্ত ধোয়া-মাজা, যাহোক, ফিরে এসে কুড়িটি টাকা আমার হাতে দিয়ে বাবু কেঁদে ফেলে বললেন, ঝি, শেষ সময়ে তুমি যা করলে মার মেয়ে কাছে থাকলে এমন করতে পারতো না। তিনিও যত কাঁদেন আমিও তত কাঁদি, দিদিমণি! আহা, কি কষ্ট! বিদেশ বিভূঁই, কেউ নেই আপনার লোক কাছে,—সমুদ্দুর পথ, টেলিগ্রাফ করলেই ত আর বউ ব্যাটা উড়ে আসতে পারে না—তাদেরই বা দোষ কি!

 ভারতীর বুকের ভিতরটা উদ্বেগ ও অজানা আশঙ্কায় হিম হইয়া উঠিল, কিন্তু মুখ ফুটিয়া কিছু জিজ্ঞাসা করিতে না পরিয়া শুধু স্থির হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

 ঝি বলিতে লাগিল, ঠাকুরমশায় ডেকে বললেন, বাবুর মায়ের বড় ব্যামো, তোমাকে যেতে হবে ক্ষান্ত। আমি আর না বলতে পারলুম না। একে নিমোনিয়া রুগী, তাতে ধর্ম্মশালার ভীড়, জানালা কবাট সব ভাঙা, একটাও বন্ধ হয় না—কি আতন্তর! মারা গেলেন বেলা পাঁচটার সময়, কিন্তু মেসের বাবুদের সব খবর দিতে, ডাকতে হাঁকতে মড়া উঠলো সেই দুটো আড়াইটে রাতে। ফিরে আসতে তাঁদের বেলা হল,—একলাটি সমস্ত ধোয়া-মোছা—

 এইবার ভারতীর বুঝিতে আর কিছু বাকী রহিল না। ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিল, অপূর্ব্ববাবুর মা মারা গেলেন বুঝি?

 ঝি ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হাঁ দিদিমণি, তাঁর বর্ম্মায় যেন মাটি কেনা ছিল। সেই যে কথায় কি বলে, না ভাড়া করে যায় সেখানে—এ ঠিক তাই। অপূর্ব্ববাবুও এখান থেকে বেরিয়েচেন, তিনিও ব্যাটার সঙ্গে ঝগড়া করে সেখানে জাহাজে উঠেচেন, সঙ্গে কেবল একজন চাকর। জাহাজেই জ্বর, ধর্ম্মশালায় নেমে একেবারে অজ্ঞান অচৈতন্য। বাড়িতে পা দিয়েই বাবু ফিরতি জাহাজে ফিরে এসে দেখেন মা যায়-যায়। গেলেনও তাই,—কিন্তু দাঁড়িয়ে একদণ্ড কথা কবার জো নেই দিদিমণি, এখনি সবাই আবার বার হবে। আসবো তখন সন্ধ্যাবেলায়,—এই বলিয়া সে গল্প করার প্রলোভন সম্বরণ করিয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিল।

 রুটির থালা তেমনি পড়িয়া রহিল, প্রথমে দুই চক্ষু তাহার ঝাপসা হইয়া উঠিল, তাহার পরে বড় বড় অশ্রুর ফোঁটা গণ্ড বাহিয়া ঝরঝর করিয়া ঝরিয়া পড়িতে

২৭২