পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কেন? দুর্ব্বলতা তখন ছিল কোথায়? স্বধর্ম্মাচরণে আস্থা ও প্রগাঢ় নিষ্ঠা সমস্তই যাহার মায়ের মুখ চাহিয়া, সে কি সত্যই এমনি ক্ষুদ্রাশয়? তাহার পূজা-অর্চ্চনা তাহার গঙ্গাস্নান, তাহার টিকি রাখা,—তাহার সকল কার্য, সকল অনুষ্ঠান—হোক না ভ্রান্ত, হোক না মিথ্যা, তবু ত সে সকল বিদ্রূপ, সকল আক্রমণ ব্যর্থ করিয়া অটল হইয়া ছিল! একি অপূর্ব্বর অস্থিরচিত্ততার এত বড়ই নিদর্শন? আজ তবে সেই লোক বর্ম্মায় আসিয়া এমন হইয়া গেল কিরূপে? এবং এত কাল এতখানি দুর্ব্বলতা তাঁহার লুকানো ছিল কোনখানে? সব্যসাচীর কাছে উত্তর জানিতে গিয়া কতদিন এই প্রশ্নই তাহার মুখে বাধিয়া গিয়াছে। শুধু ত কৌতূহলবশেই নয়, হৃদয়ের ব্যথার মধ্যে দিয়াই সে কতবার ভাবিয়াছে, এ-সংসারে যাহা কিছু জানা যায়, দাদা ত সমস্তই জানেন, তবে এ সমস্যারও উদ্ভেদ তিনিই করিয়া দিবেন। কেবল সঙ্কোচ ও সরমেই সে অপূর্ব্বর প্রসঙ্গ উত্থাপন করিতে পারে নাই।

 ভাবিতে ভাবিতে সহসা নূতন প্রশ্ন তাহার মনে আসিল। কর্ম্মদোষে যখন সবাই অপূর্ব্বর প্রতি বিরূপ তখনও সুদ্ধমাত্র যে লোকটির সহানুভূতি হইতে সে বঞ্চিত হয় নাই, সে সব্যসাচী। কিন্তু, কিসের জন্য? শুধু কি কেবল ভগিনী বলিয়া তাহারই সমবেদনায়? তাঁহার স্নেহ পাইবার মত নিজস্ব কি অপূর্ব্বর কিছুই ছিল না? সত্য সত্যই কি ভারতী এত ক্ষুদ্রেই এত বৃহৎ ভালবাসা সমর্পণ করিয়া বসিয়াছে! সে দুর্দিনে সতর্ক করিবার মত পুঁজি কি কিছুই তাহার ছিল না? হৃদয় কি তাহার এমনি কাঙাল এমনি দেউলিয়া হইয়াই ছিল!

 এমনি করিয়া একভাবে বসিয়া ঘণ্টা-দুই সময় যখন কোথা দিয়া কাটিয়া গিয়াছে, ঝি ফিরিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। তখন হোটেলে জরুরি কাজের মধ্যে সমস্ত আলোচনা নিঃশেষ করিয়া যাইবার তাহার অবসর ছিল না, এখন একটুখানি ছুটি পাইয়াছে। অপূর্ব্ব ও ভারতীর মাঝখানে যে একটি রহস্যময় মধুর সম্বন্ধ আছে, তাহা আভাসে-ইঙ্গিতে অনেকেই জানিত, ঝিরও অবিদিত ছিল না। তবে, সহসা এমন কি ঘটিল যাহাতে অপূর্ব্বর এতবড় বিপদের দিনেও ভারতী তাহার ছায়া স্পর্শ করিল না? স্ত্রীলোক হইয়া এতবড় সংবাদটা না জানা পর্যয়ন্ত ক্ষান্তর মুখে অন্নজল রুচিতেছিল না। তাই সে কোন একটা অছিলায় উপস্থিত হইয়া প্রথমে অবাক হইল, পরে কহিল, কিছুই তো ছোঁওনি দেখছি।

 ভারতী লজ্জা পাইয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িয়া বলিল, না।

 ঝি মাথা নাড়িয়া, কণ্ঠস্বর করুণ করিয়া কহিল, খাওয়া যায় না, দিদিমণি, যে কাণ্ড চোখে দেখে এলুম। বিশ্বাস না হয় গিয়ে দেখবে চল, ভাতের থালা আমার যেমন তেমনি পড়ে রয়েচে,—মুখে দিয়েচি কি না-দিয়েচি।

২৭৪