ইহার অবাঞ্ছিত সমবেদনায় ভারতীর সঙ্কোচের অবধি রহিল না। জোর করিয়া একটুখানি হাসিবায় চেষ্টা করিয়া বলিল, কাউকে দিয়ে একখানা গাড়ি ডাকিয়ে দাও না ঝি!
যাবে বুঝি?
হাঁ, একবার দেখি গিয়ে কি হল।
ক্ষান্ত বলিল, আজ সকালে ঠাকুর মশাইকে কি সাধ্যি সাধনা। আমি শুনে বলি সে কি কথা! মানুষের আপদ-বিপদে করব না তো আর করব কবে? হাতের কাজ পড়ে রইল, যেমন ছিলুম, তেমনি বেরিয়ে পড়লুম। ভাগ্যি তবু—
সেই সমস্ত পুনরাবৃত্তি আশঙ্কায় ভারতী ব্যস্ত হইয়া উঠিল। বাধা-দিয়া কহিল, তুমি অসময়ে যা করেচ তার তুলনা নেই। কিন্তু আর দেরি কোরো না ঝি, গাড়ি একখানা আনিয়ে দাও। আমার যেতে হলে একটু বেলা-বেলি যাওয়াই ভাল। ঘরের কাজ-কর্ম্ম ততক্ষণ সেরে রাখি।
ঝি লোক মন্দ নয়। সে গাড়ি ডাকিতে গেল এবং দুঃসময়ে সাহায্য করিবার আগ্রহে এমন কথাও জানাইল যে ঘরের কাজ-কর্ম্ম আজ না হয় সে-ই করিয়া দিবে। এমন কি খাবার জিনিসগুলো যখন ছোঁয়া যায় নাই, তখন তাহাও পরিষ্কার করিয়া দিতে তাহার বাধা নাই। শেষে কাপড় ছাড়িয়া গঙ্গাজল মাথায় দিলেই চলিবে। বিদেশ বিভুঁয়ে এমন করিতেই হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি।
মিনিট-পনের পরে গাড়ি আসিয়া পৌঁছিলে ভারতী সঙ্গে কিছু টাকা লইয়া ঘরে-দ্বারে তালা বন্ধ করিয়া বাহির হইয়া পড়িল। পান্থশালায় আসিয়া যখন উপস্থিত হইল, তখনও বেলা আছে। দ্বিতলের একখানা উত্তর ধারের ঘর দেখাইয়া দিয়া হিন্দুস্থানী দরোয়ান জানাইয়া দিল যে, বাঙালীবাবু ভিতরে আছেন; এবং বাঙালী রমণীর কাছে বাঙলা ভাষাতেই প্রকাশ করিয়া জানাইল যে, যেহেতু তিনদিনের বেশি থাকার রুল নাই, অথচ ছয় দিন উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে, তখন ম্যানিজার সাবের লুটীশ হইলে তাহার নোকরিতে বহুত গুলমাল হইয়া যাইবে।
ভারতী ইঙ্গিত বুঝিল। অঞ্চল খুলিয়া গুটি-দুই টাকা বাহির করিয়া তাহার হাতে দিয়া তাহারই নির্দ্দেশমত উপরের ঘরে আসিয়া দেখিল সমস্ত মেঝেটা তখনও জলে থৈ থৈ করিতেছে, জিনিস-পত্র চারিদিকে ছড়ানো এবং তাহারই একধারে একখানা কম্বলের উপরে অপূর্ব্ব উপুড় হইয়া পড়িয়া। নূতন উত্তরীয় বস্ত্রখানা মুখের উপর চাপা দেওয়া,—সে জাগিয়া আছে কিংবা ঘুমাইতেছে তাহা বুঝা গেল না। ভারতী শুনিয়াছিল সঙ্গে চাকর আসিয়াছে, কিন্তু কাছাকাছি কোথাও সে ছিল না, কারণ
২৭৫