পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আর ঠাঁই রাখেনি? অপূর্ব্ববাবু, হৃদয়াবেগ দুর্মূল্য বস্তু, কিন্তু চৈতন্যকে আছন্ন করতে দিলে এতবড় শত্রু আর মানুষের নেই।

 অপূর্ব্ব অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, কিন্তু ধর্ম্মসাধনা বা আত্মার মুক্তির কামনায় আমি সংসার ত্যাগ করতে চাইনি ডাক্তার, যদি করি, পরার্থেই কোরব। আমাকে আপনাদের বিশ্বাস করা কঠিন, না করলেও দোষ দেবার নেই, কিন্তু একদিন যে অপূর্ব্বকে আপনারা জানতেন, মায়ের মৃত্যুর পরে সে অপূর্ব্ব আমি আর নেই।

 ডাক্তার উঠিয়া আসিয়া তাহার গায়ে হাত দিয়া বলিলেন, তোমার এ কথাটা যেন সত্য হয় অপূর্ব্ব।

 অপূর্ব্ব গাঢ় কণ্ঠে বলিল, এখন থেকে আমি দেশের কাজে, দশের কাজে, দীনদরিদ্রের কাজেই আত্মনিয়োগ কোরব। এই বলিয়া সে ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া কহিতে লাগিল, কলকাতায় আমার বাড়ি, সহরেই আমি মানুষ, কিন্তু সহরের সঙ্গে আর আমার কিছুমাত্র সম্বন্ধ রইল না। এখন থেকেই পল্লীসেবাই হবে আমার একমাত্র ব্রত। একদিন কৃষিপ্রধান ভারতে পল্লীই ছিল প্রাণ, পল্লীই ছিল তার অস্থি-মজ্জা শোনিত। আজ সে ধ্বংসোন্মুখ। ভদ্রজাতি তাদের ত্যাগ করে সহরে এসেছে, সেখান থেকে তাদের অহর্নিশি শাসন করে এবং শোষণ করে। এ ছাড়া আর কোন সম্বন্ধ-বন্ধন তারা রাখেনি। না রাখুক, কিন্তু চিরদিন যারা এঁদের মুখের অন্ন এবং পরণের বস্ত্র যুগিয়ে দেয়, সেই কৃষককুল আজ নিরন্ন, নিরক্ষর এবং নিরুপায় হয়ে মৃত্যুপথে দ্রুতবেগে চলেচে। এখন থেকে আমি তাদের কল্যাণেই আত্মনিয়োগ কোরব এবং ভারতীও আমাকে প্রাণপণে সাহায্য করবেন প্রতিশ্রুতি হয়েচেন। গ্রামে গ্রামে পাঠশালা খুলে, আবশ্যক হলে কুটীরে কুটীরে গিয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করবার ভার উনি নেবেন। আমার সন্ন্যাস দেশের জন্যে নিজের জন্যে নয় ডাক্তার

 ডাক্তার বলিলেন, সাধু প্রস্তাব।

 তাঁহার মুখ হইতে কেবল এই দুটি কথাই কেহ প্রত্যাশা করে নাই। ভারতী ম্লান হইয়া কহিল, আর একদিক দিয়ে ধরলে এ তো তোমারই কাজ দাদা। এই কৃষিপ্রধান দেশে কৃষক বড় হয়ে না উঠলে ত কোন কিছুই হবে না!

 ডাক্তার কহিলেন, আমি ত প্রতিবাদ করিনি ভারতী।

 কিন্তু তোমার উৎসাহও ত নেই দাদা।

 ডাক্তার মাথা নাড়িয়া বলিলেন, দরিদ্র কৃষকের ভালো করতে চাও, তোমাদের আমি আশীর্ব্বাদ করি। কিন্তু আমার কাজে সাহায্য কোরচ মনে করবার প্রয়োজন

২৮৯