পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভয়ানক আঘাত লেগেছে। হয় আমাদের কথা শোন, নইলে বন্দে মাতরমের দিব্বি করে বলচি তোমাদের অধীনে আমরা স্বাধীন হবই হব। দেখি, কার সাধ্য বাধা দেয়!—এ যে কি প্রার্থনা, এবং কি এর স্বরূপ সে আমার বুদ্ধির অতীত। শুধু জানি, তাঁদের এই চাওয়া এবং পাওয়ার সঙ্গে আমার সম্বন্ধ নেই।

 একটুখানি থামিয়া বলিলেন, সংস্কার মানে মেরামত—উচ্ছেদ নয়। গুরুভার যে অপরাধ আজ মানুষের অসহ্য হয়ে উঠেচে তাকেই সুসহ্য করা; যে যন্ত্র বিকল হয়ে আসচে মেরামত করে তাকেই সুপ্রতিষ্ঠিত করার যে কৌশল বোধ হয় তারই নাম শাসন-সংস্কার। একটা দিনের জন্যও ফাঁকি আমি চাইনি, একটা দিনের জন্যও বলিনি কারাগারের পরিসর আমার আর একটুখানি বাড়িয়ে দিয়ে আমাকে ধন্য কর। ভারতী, আমার কামনায়, আমার তপস্যায় আত্ম-বঞ্চনার অবসর নেই! এ তপস্যা সাঙ্গ হবার শুধু দুটি মাত্র পথ খোলা আছে—এক মৃত্যু, দ্বিতীয় ভারতের স্বাধীনতা।

 তাঁহার এই কথাগুলির মধ্যে নূতন কিছুই ছিল না, তথাপি মৃত্যু ও এই ভয়াবহ সঙ্কল্পের পুনরুল্লেখে ভারতীর বুকের মধ্যে অশ্রু আলোড়িত হইয়া চক্ষু জলে ভরিয়া গেল। কহিল, কিন্তু একাকী কি করবে দাদা, একে একে সবাই যে তোমাকে ছেড়ে দূরে সরে গেল?

 ডাক্তার বলিলেন, যাবেই ত। আমার দেবতা যে ফাঁকি সইতে পারেন না বোন।

 ভারতীর মুখে আসিল, সংসারে সবাই ফাঁকি নয় দাদা, হৃদয় পাথর না হয়ে গেলে তা টের পেতে। কিন্তু এ কথা আজ সে উচ্চারণ করিল না।

 আহার শেষ হইলে ডাক্তার হাত-মুখ ধুইয়া চেয়ারে আসিয়া বরিলেন। কেহই লক্ষ্য করিল না যে, তাঁহার চোখের দৃষ্টি কিসের উৎকণ্ঠিত প্রতীক্ষায় ধীরে ধীরে বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিতেছে। এবং একটা কান যে বহুক্ষণ হইতেই সদর দরজায় সজাগ হইয়াছিল তাহা কেহই জানিত না। পথের ধারে কি একটা শব্দ হইল, তাহা আর কেহ প্রায় গ্রাহ্য করিল না, কিন্তু ডাক্তার সচকিতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, নীচে অপূর্ব্ববাবুর চাকর আছেন না? জেগে আছে? ওতে হনুমন্ত, দোরটা একবার খুলে দাও।

 কোথায় কাহার কিরূপ শয্যা প্রস্তুত হইবে তাহাই ভারতী সুমিত্রাকে জিজ্ঞাসা করিতেছিল, সবিস্ময়ে মুখ ফিরাইয়া কহিল, কাকে দাদা? কে এসেচেন?

 ডাক্তার বলিলেন, হীরা সিং। তার আসার আশায় পথ চেয়ে বসে আছি। বল কবি, কতকটা কাব্যের মত শোনাল না? এই বলিয়া তিনি হাসিলেন।

২৯৩