পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ভারতী বলিল, এই দুর্য্যোগে তোমার একার কাব্যের জ্বালাতেই আমরা সন্ত্রস্ত হয়ে আছি। আবার ভগ্নদূত কিসের জন্যে?

 শশী কহিল, ভগ্নদূত তুচ্ছ নয় ভারতী, সে না হলে অতবড় মেঘনাদবধ কাব্য রচনাই হোত না।

 দেখি, ইনি কোন্ কাব্য রচনা করেন! এই বলিয়া ভারতী উঁকি মারিয়া দেখিল অপূর্ব্বর ভৃত্য বাহিরের কবাট খুলিতে যে ব্যক্তি প্রবেশ করিল সে সত্যই হীরা সিং। ক্ষণেক পরে আগন্তুক উপরে আসিয়া সকলকে অভিবাদন করিল এবং হাতজোড় করিয়া সব্যসাচীকে প্রণাম করিল! পরণে তাহার সেই অতি সুপরিচিত সরকারী উর্দ্দি, সরকারী চাপরাশ, সরকারী মুরাঠা, কোমরে টেলিগ্রাফ পিয়নের চামড়ার ব্যাগ,—এ সমস্তই ভিজিয়া ভারি হইয়া উঠিয়াছে। বিপুল দাড়ি-গোঁপ বহিয়া জল ঝরিতেছে বাঁ হাত দিয়া নিঙড়াইয়া বোধ হয় নিজকে কিঞ্চিৎ হাল্কা করিবার চেষ্টা করিল এবং তাহারই ফাঁক দিয়া অস্ফুটধ্বনি শুনা গেল, রেডি।

 ডাক্তার লাফাইয়া উঠিলেন, থ্যাঙ্ক ইউ? থ্যাঙ্ক উই সরদারজী! কখন?

 নাউ। এই বলিয়া সে সকলকে পুনশ্চ অভিবাদন করিয়া নীচে যাইতেছিল, কিন্তু সকলেই সমস্বরে চিৎকার করিয়া উঠিলেন, কি হয়েচে সরদারজী? কি নাউ?

 অথচ সবাই জানিত এই মানুষটির গলায় ছুরি দিলে রক্ত ছুটিবে, কিন্তু বিনা হুকুমে কথা ফুটিবে না। সুতরাং উত্তরের পরিবর্ত্তে তাহার ঘন কৃষ্ণ শ্মশ্রু-গুম্ফ ভেদ করিয়া গুটিকয়েক দাঁত ছাড়া আর যখন কিছু বাহির হইল না, তখন বিস্ময়াপন্ন কেহই হইল না। সবাই জানিত, ইহার নিন্দা-খ্যাতি, মান-অপমান, শত্রু-মিত্র নাই; দেশের কাজে সব্যসাচীকে সে সর্দ্দার মানিয়া এ জীবনের সমস্ত ভালমন্দ, সমস্ত সুখদুঃখ বিসর্জ্জন দিয়া কঠোর সৈনিক-বৃত্তি মাথায় তুলিয়া লইয়াছে। আর তাহার তর্ক নাই, আলোচনা নাই, সময়-অসময়ের হিসাব নাই, কিছু একটা কঠিন কাজের ভার ছিল; কর্ত্তব্য পালন করিয়া নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেল। ইহাদের কৌতূহল নিবৃত্তি করিয়া ডাক্তার নিজে যাহা বলিলেন তাহা সংক্ষেপে এইরূপ—

 ক্ষতি এবং অনিষ্ট কত যে হইয়াছে দূর হইতে নিরুপণ করা শক্ত! সম্ভবতঃ, যথেষ্ট হইয়াছে। কিন্তু যতই হৌক দুটা কাজ তাঁহাকে করিতেই হইবে। তাঁহাদের জ্যামেকা ক্লাবের যে অংশটা সিঙ্গাপুরে আছে তাহাকে বাঁচাইতেই হইবে। এবং যেখানে হৌক এবং যেমন করিয়া হৌক, ব্রজেন্দ্রকে তাঁহার খুঁজিয়া বাহির করিতেই হইবে। নদীর দক্ষিণে সিরিয়মের সন্নিকটে একখানা চীনা জাহাজ মাল বোঝাই করিয়া দেশে চলিয়াছে, কাল অতি প্রত্যুষেই তাহা ছাড়িয়া যাইবে, ইহাতেই কোনমতে একটা স্থান পাওয়া গিয়াছে। ষেই সংবাদই হীরা সিং এইমাত্র দিয়া গেল।

২৯৪