পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৩০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হয়ে যেতো। এই বলিয়া পূর্ব্ব স্মৃতির আঘাতে তাহার সর্ব্বদেহ কণ্টকিত হইয়া উঠল।

 শশী এ ঘটনা জানিত না, জানানো কেহ আবশ্যক বিবেচনাও করে নাই। অপূর্ব্বর কথাটাকে সে প্রচলিত বিনয় ও শ্রদ্ধাভক্তির নিদর্শনের অতিরিক্ত কিছুই মনে করিল না। কহিল, ভ্রম ত করে অনেকেই, কিন্তু দণ্ডভোগ করে চলে যে নিজের জন্মভূমি। আমি ভাবি, ডাক্তার, আপনার চেয়ে যোগ্যতর ব্যক্তি কে আছে? কার এতখানি জ্ঞান? জাতি ও দেশ নির্ব্বিশেষে কার এতখানি রাষ্ট্রতন্ত্রের অভিজ্ঞতা? কার এতখানি ব্যথা? অথচ, কিছুই কাজে এলো না! চায়নার আয়োজন নষ্ট হয়ে গেল, পিনাঙের গেল, বর্ম্মার কিছুই রইল না, সিঙ্গাপুরেরও যাবে নিশ্চয়,—এক কথায়, আপনার এতকালের সমস্ত চেষ্টাই ধ্বংস হবার উপক্রম হয়েছে। শুধু প্রাণটাই বাকী, সেও কোন দিন যায়!

 ডাক্তার মুখ টিপিয়া একটুখানি হাসিলেন। শশী কহিল, হাসুন আর যাই করুন, এ আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্চি।

 ডাক্তার তেমনি হাসিমুখে প্রশ্ন করিলেন, দিব্যচক্ষে আর কিছু দেখতে পাও না কবি?

 শশী বলিল, তাও পাই। তাই ত আপনাকে দেখলেই মনে হয়, নিরুপদ্রব, শান্তিময় পথে যদি আমাদের সত্যকার পথের দাবী সূচ্যগ্র মাত্রও খোলা থাকতো!

 অপূর্ব্ব বলিয়া উঠিল, বাঃ। একই সঙ্গে একেবারে দুই উল্টো কথা।

 সুমিত্রা হাসি গোপন করিতে মুখ ফিরাইল, ডাক্তার নিজেও হাসিয়া বলিলেন, তার কারণ, ওঁর মধ্যে দুটো সত্তা আছে অপূর্ব্ববাবু। একজন শশী, আর একজন কবি। এই জন্যই একের মুখের কথা অপরের মনের কথায় গিয়ে ধাক্কা দিয়ে এমন বেসুরার সৃষ্টি করে। একটু থামিয়া বলিলেন, বহু মানবের মধ্যেই এমনি আর একজন নিভৃতে বাস করে। সহজে তাকে ধরা যায় না। তাই মানুষের কথার ও কাজের মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাব মাত্রই তার কঠোর বিচার করলে অবিচারের সম্ভাবনাই থাকে বেশি। অপুর্ব্ববাবু, আমি তোমাকে চিনতে পেরেছিলাম, কিন্তু পারেননি সুমিত্রা। ভারতী, জীবনযাত্রার মাঝখানে যদি এমন আঘাত কখনো পাও দিদি, পরলোকগত দাদার এই কথাটি তখন ভুলো না। কিন্তু এইবার আমি উঠি। ঘাটে আমার নৌকা বাঁধা আছে, ভাঁটার মুখে অনেকখানি দাঁড় না টানলে আর ভোর রাত্রে জাহাজ ধরতে পারব না।

 ভারতী শঙ্কায় আকুল হইয়া উঠিল, কহিল, এই ভয়ঙ্কর নদীতে? এই ভীষণ ঝড়ের রাত্রে?

২৯৭