পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

এর চেয়ে বড় জবাব তাদের মুখে আমি আশা করিনি। কিন্তু তাতে তাঁর সুবিধে হবে না, কারণ এর জায়গায় আমি আসবো। আমার নাম রামদাস তলওয়ারকর—আমি মারাঠি ব্রাহ্মণ। তলওয়ার শব্দটার একটা অর্থ আছে, আপনার বাবাকে সেটা জেনে নিতে বলবেন। গুড ইভনিং। চলুন বাবুজি,—এই বলিয়া সে অপূর্ব্বর হাত ধরিয়া একেবারে রাস্তায় আসিয়া পড়িল।

 মেয়েটির মুখের চেহারা অপূর্ব্ব কটাক্ষে দেখিতে পাইয়াছিল, শেষ দিকটায় সে যে কিরূপ কঠিন হইয়া উঠিয়াছিল মনে করিয়া কিছুক্ষণ পর্য্যন্ত সে কথা কহিতেই পারিল না, তারপর আস্তে আস্তে বলিল, এটা কি হ’ল তলওয়ারকর?

 তলওয়ায়কর উত্তরে কহিল, এই হ’ল যে আপনি উঠে গেলেই আমাকে আসতে হবে। শুধু খবরটা যেন পাই।

 অপূর্ব্ব কহিল, অর্থাৎ দুপুরবেলা আপনার স্ত্রী এখানে একাকী থাকবেন।

 রামদাস কহিল, না একাকী নয়, আমার দু’বছরের একটি মেয়ে আছে।

 অর্থাৎ আপনি পরিহাস করচেন?

 না, আমি সত্যি বলচি। পরিহাস করতে আমি জানিইনে।

 অপূর্ব্ব তাহার সঙ্গীর মুখের প্রতি একবার চাহিয়া দেখিল, তারপরে ধীরে ধীরে কহিল, তাহলে এ বাসা আমার ছাড়া চলবে না। তাহার মুখের কথা শেষ না হইতেই রামদাস অকস্মাৎ তাহার দুই হাত নিজের বলিষ্ঠ দুই হাতে ধরিয়া ফেলিয়া প্রচণ্ড একটা ঝাঁকানি দিয়া বলিয়া উঠিল, এই আমি চাই বাবুজি, এই ত আমি চাই। অত্যাচারের ভয়ে আমরা অনেক পালিয়েচি, কিন্তু—ব্যস্!

 একটা হাত সে ছাড়িয়া দিল, কিন্তু একটা হাত সে শেষ পর্য্যন্ত ধরিয়াই রহিল। কেবল ট্রেন ছাড়িলে সেই হাতে আর একবার মস্ত নাড়া দিয়া নিজের দুই হাত এক করিয়া নমস্কার করিল।

 সন্ধ্যা হইতে তখনও বিলম্ব ছিল, ঘণ্টা খানেকের মধ্যে ট্রেনেরও আর সময় ছিল না বলিয়া স্টেশনের এই দিকের প্লাটফর্ম্মে যাত্রীর ভিড় ছিল না। এইখানে অপূর্ব্ব পায়চারি করিয়া বেড়াইতে লাগিল। হঠাৎ তাহার মনে হইল কাল হইতে আজ পর্য্যন্ত এই একটা দিনের ব্যবধানে জীবনটা যেন কোথা দিয়া কেমন করিয়া একেবারে বহুবৎসর দীর্ঘ হইয়া গিয়াছে। খেলা-ধূলা ও এমনি সব তুচ্ছ কাজের মধ্যে সে কখন যেন ক্লান্ত হইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, অকস্মাৎ যেখানে ঘুম ভাঙ্গিল, সেখানে সমস্ত দুনিয়ার কর্ম্মস্রোত কেবলমাত্র কাজের বেগেই যেন ক্ষেপিয়া উঠিয়াছে। বিশ্রাম নাই, বিরতি নাই, আনন্দ নাই, অবসর নাই, মানুষে মানুষে সংঘর্ষের মধ্যাহ্ন সূর্য্য দুই হাতে কেবল মুঠা মুঠা করিয়া অহরহ আগুন ছড়াইয়া চলিয়াছে।

২৮