পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আলোকে আসেন। তাঁহার স্বর্গীয় হওয়ার পরে মা কোন এক মিশনরি দুহিতার দাসী হইয়া বাঙ্গালোরে আসেন। সেখানে জোসেফ সাহেবের রূপে মুগ্ধ হইয়া তাঁহাকে বিবাহ করেন। ভারতী পৈতৃক ভট্টাচার্য্য নামটা কদর্য্য বলিয়া পরিত্যাগ করিয়া জোসেফ নাম গ্রহণ করিয়াছে, সেই অবধি সে মিস মেরি-ভারতী জোসেফ নামে পরিচিত। হাকিমের প্রশ্নে সে ফল-মূল উপহার দিতে যাওয়া অস্বীকার করিল, কিন্তু তাহার কণ্ঠস্বর হইতে মুখের চেহারায় মিথ্যা বলার বিড়ম্বনা এমনি ফুটিয়া উঠিল যে শুধু হাকিম নয়, তাঁহার পিয়াদাটার চক্ষুকে পর্য্যন্ত তাহা ফাঁকি দিতে পারিল না। কোন পক্ষেই উকিল ছিল না, সুতরাং জেরার প্যাচে প্যাঁচে পাক খাইয়া তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র বস্তু সুবৃহৎ হইয়া উঠিবার অবকাশ পাইল না। বিচার একদিনেই শেষ হইল, তেওয়ারী রেহাই পাইল, কিন্তু বিচারক অপূর্ব্বর কুড়ি টাকা অর্থদণ্ড করিলেন। জীবনের এই প্রভাতকালে রাজদ্বারে বিনা অপরাধে দণ্ডিত হইয়া তাহার মুখ মলিন হইয়া গেল। টাকা কয়টি গণিয়া দিয়া বাহির হইতেছে, দেখিল, দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইয়া রামদাস। অপূর্ব্বর মুখ দিয়া প্রথমেই বাহির হইয়া গেল—কুড়ি টাকা ফাইন হ’ল রামদাস, কি করা যাবে? আপিল?

 আবেগ ও উত্তেজনায় তাহার কণ্ঠস্বরের শেষ দিকটা যেন কাঁপিয়া উঠিল। রামদাস তাহার ডান হাতটা নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া আসিয়া কহিল, অর্থাৎ কুড়ি টাকার বদলে দুহাজার টাকা আপনি লোকসান করতে চান।

 তা হোক—কিন্তু এ যে ফাইন! শাস্তি! রাজদণ্ড!

 রামদাস হাসিয়া কহিল, কিসের দণ্ড? যে মিথ্যে মামলা আনলে, মিথ্যে সাক্ষী দেওয়ালে,—আর যে তাকে প্রশ্রয় দিলে তাহাদের দণ্ড ত? কিন্তু এর উপরেও একটা আদালত আছে যার বিচারক ভুল করেন না,—সেখানে আপনি বেকসুর খালাস পেয়েচেন বলে দিচ্চি।

 অপূর্ব্ব বলিল, কিন্তু লোকে ত বুঝবে না রামদাস। তাদের কাছে এ দুর্নাম যে আমার চিরকালের সঙ্গী হয়ে রইল।

 রামদাস সস্নেহে তাহার হাতের উপর একটা চাপ দিয়া বলিল, চলুন, আমরা নদীর ধারে একটু বেড়িয়ে আসিগে।

 পথে চলিতে চলিতে কহিল, অপুর্ব্ববাবু, আমি অফিসের কাজে আপনার ছোট হলেও বয়সে বড়। যদি দুটো কথা বলি কিছু মনে করবেন না। অপূর্ব্ব চুপ করিয়া রহিল। রামদাস বলিতে লাগিল, এ মকদ্দমার কথা আমি আগেই জানতাম, কি হবে তাতেও আমার সন্দেহ ছিল না। লোকের কথা আপনি বলছিলেন, যে

৩৩