পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পূর্ব্বে তেওয়ারী যখন ছুটি চাহিয়া জানাইল যে আজ দুপুরবেলা সে বর্ম্মীদের ফয়ার মন্দিরে তামাসা দেখিতে যাইবে, তখন অপূর্ব্ব না হাসিয়া থাকিতে পারিল না। সকৌতুকে প্রশ্ন করিল, তোর যে আবার তামাসা দেখতে সখ হল তেওয়ারী?

 তেওয়ারী কহিল, বিদেশের যা কিছু সব দেখা ভাল ছোটবাবু

 অপূর্ব্ব বলিল, তা বটে। খোঁড়া সাহেব হাসপাতালে, এখন আর রাস্তায় বেরোতে ভয় নাই। তা যাস, কিন্তু একটু সকাল সকাল ফিরে আসিস। কেউ সঙ্গে থাকবে ত?

 তাহার স্বদেশবাসী যে লোকটির সহিত কাল তেওয়ারীর আলাপ হইয়াছে সেই আসিয়া আজ তাহাকে তামাসা দেখাইয়া আনিবে স্থির হইয়াছিল। সাহেবের দুর্ঘটনার সংবাদে সে এতই খুশী হইয়াছিল যে তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইতে তাহার মুহুর্ত্ত বিলম্ব ঘটে নাই।

 তাহাকে বাহিরে যাইবার হুকুম দিয়া অপূর্ব্ব যথাসময়ে আফিস চলিয়া গেল, এবং ইহার ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই তেওয়ারীর দেশের লোক আসিয়া তাহাকে বর্ম্মী তামাসা দেখাইয়া আনিতে সঙ্গে লইয়া গেল। তালার একটা চাবি অপূর্ব্বর নিজের কাছেই থাকিত, সুতরাং ফিরিয়া আসিতে বিলম্ব ঘটিলেও ছোটবাবুর যে বিশেষ অসুবিধা হইবে না তেওয়ারীর তাহা জানা ছিল। নিষ্কণ্টক হইয়া আজ আর তাহার ফুর্ত্তির অবধি ছিল না।

 অপরাহ্ণ বেলায় ঘরে ফিরিয়া অপূর্ব্ব দেখিল দরজায় তালা বন্ধ, তেওয়ারী তখন পর্য্যন্ত তামাসা দেখিয়া ফিরে নাই। পকেট হইতে চাবি বাহির করিয়া খুলিতে গিয়া দেখিল চাবি লাগে না, এ কোন্ এক অপরিচিত তালা, এত তাহাদের নয়! তেওয়ারী এ কোথায় পাইল, কেনই বা সে তাহাদের পুরাতন ভাল তালার বদলে এই একটা নূতন তালা দিতে গেল, ইহার চাবিই বা কোথায়, কেমন করিয়াই বা সে ঘরে ঢুকিবে কিছুই ভাবিয়া পাইল না। বোধ হয় মিনিট দুই সে এই ভাবে দাঁড়াইয়া, ত্রিতলের দ্বার খুলিয়া সেই ক্রীশ্চান মেয়েটি মুখ বাহির করিয়া কহিল, দাঁড়ান, আমি খুলে দিচ্চি, এই বলিয়া সে নীচে নামিয়া আসিয়া অসঙ্কোচে অপূর্ব্বর পাশে আসিয়া দাঁড়াইতে সে বিষয়ে ও লজ্জায় যেন একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া গেল। তেওয়ারী নাই, কি তার হইল, এবং কি জন্য কেমন করিয়া ঘরের চাবি সাহেবের মেয়ের হাতে গিয়া পড়িল তাহা সে ভাবিয়া পাইল না। স্বল্প আলোকিত এই সংকীর্ণ সিঁড়িটায় দুইজনের দাঁড়াইবার মত যথেষ্ট স্থান ছিল না, অপূর্ব্ব এক ধাপ নীচে নামিয়া আর এক দিকে মুখ ফিরাইয়া রহিল। অনাত্মীয় যুবতী রমণীর সহিত নির্জ্জনে পাশাপাশি দাঁড়াইয়া কথা কহা তাহার অভ্যাসই ছিল না, তাই মেয়েটি যখন তাহাকে উদ্দেশ করিয়া কহিল, মা, বলছিলেন চাবি বন্ধ করে আমি ভাল কাজ

৩৭