পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আর এ রেচারারা বাঙালী বলেই শুধু বাঙালী হয়ে এদের প্রতি অত্যাচার করব? ওরে বাবা, বাইরে থেকে তোরা পুলিশকে যত মন্দ মনে করিস, সবাই তা নয়। ভাল মন্দ সকলের মধ্যেই আছে, কিন্তু মুখ বুঁজে যত দুঃখ আমাদের পোহাতে হয় তা যদি জানতে ত তোমার এই দারোগা কাকাবাবুটিকে অত ঘৃণা করতে পারতে না অপূর্ব্ব।

 অপূর্ব্ব লজ্জিত হইয়া কহিল, আপনি কর্ত্তব্য করতে এসেচেন, তাই বলে আপনাকে ঘৃণা কেন করব কাকাবাবু! এই বলিয়া সে হেঁট হইয়া তাঁহার পদস্পর্শ করিয়া কপালে ঠেকাইল। নিমাইবাবু খুশী হইয়া আশীর্ব্বাদ করিয়া কহিলেন, হয়েছে, হয়েচে। চল, একটু শীঘ্র যাওয়া যাক, লোকগুলো ক্ষুধায় তৃষ্ণার সারা হচ্চে, একটু পরীক্ষা করে ছেড়ে দেওয়া যাক। এই বলিয়া তিনি হাত ধরিয়া তাহাকে সঙ্গে করিয়া বাহির করিয়া আনিলেন।

 পুলিশ-স্টেশনে প্রবেশ করিয়া দেখা গেল, সুমুখের হল-ঘরে জন-ছয়েক বাঙালী মোটঘাট লইয়া বসিয়া আছে, অগদীশবাবু ইতিমধ্যেই তাহাদের টিনের তোরঙ্গ ও ছোট বড় পুঁটুলি খুলিয়া তদারক শুরু করিয়া দিয়াছেন। শুধু যে লোকটির প্রতি তাঁহার অত্যন্ত সন্দেহ হইয়াছে তাহাকে আর একটা ঘরে আটকাইয়া রাখা হইয়াছে। ইহারা সকলেই উত্তর-ব্রহ্মে বর্ম্মা অয়েল কোম্পানীর তেলের খনির কারখানায় মিস্ত্রীর কাজ করিতেছিল, সেখানে জলহাওয়া সহ্য না হওয়ায় চাকরির উদ্দেশে রেঙ্গুনে চলিয়া আসিয়াছে। ইহাদের নাম ধাম ও বিবরণ লইয়া সঙ্গের জিনিসপত্রের পরীক্ষা করিয়া ছাড়িয়া দেওয়া হইলে, পোলিটিক্যাল সাসপেক্ট সব্যসাচী মল্লিককে নিমাইবাবুর সম্মুখে হাজির করা হইল।

 লোকটি কাশিতে কাশিতে আসিল। বয়স ত্রিশ-বত্রিশের অধিক নয়, কিন্তু যেমন রোগা তেমনি দুর্ব্বল। এইটুকু কাশির পরিশ্রমেই সে হাঁপাইতে লাগিল। মনে হয় না যে সংসারের মিয়াদ আর তাহার দীর্ঘদিন আছে, ভিতরের কি একটা দুরারোগ্য রোগে সমস্ত দেহটা যেন দ্রুতবেগে ক্ষয়ের দিকে ছুটিয়াছে। কেবল আশ্চর্য্য সেই রোগা মুখের অদ্ভুত দুটি চোখের দৃষ্টি। সে চোখ ছোট কি বড়, টানা কি গোল, দীপ্ত কি প্রভাহীন, এ সকল বিবরণ দিতে যাওয়াই বৃথা—অত্যন্ত গভীর জলাশয়ের মত কি যে তাহাতে আছে, ভয় হয় এখানে খেলা চলিবে না, সাবধানে দূরে দাঁড়ানোই প্রয়োজন। ইহার কোন অতল তলে তাহার ক্ষীণ প্রাণশক্তিটুকু লুকানো আছে, মৃত্যুও সেখানে প্রবেশ করিতে সাহস করে না— কেবল এই জন্যেই যেন সে আজও বাঁচিয়া আছে। অপূর্ব্ব মুগ্ধ হইয়া সেইদিকে চাহিয়াছিল, সৎসা নিমাইবাবু তাহার বেশভূষার বাহার ও পারিপাট্যের প্রতি অপূর্ব্বর দৃষ্টি আকৃষ্ট করিয়া সহাস্যে কহিলেন,

৪৯