পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বাবুটির স্বাস্থ্য গেছে, কিন্তু সখ ষোল আনাই বজায় আছে তা স্বীকার করতে হবে। কি বল অপূর্ব্ব?

 এতক্ষণে অপূর্ব্ব তাহার পরিচ্ছদের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া মুখ ফিরাইয়া হাসি গোপন করিল। তাহার মাথার সম্মুখদিকে বড় বড় চুল, কিন্তু ঘাড় ও কানের দিকে নাই বলিলেই চলে,—এমনি ছোট করিয়া ছাঁটা। মাখায় চেরা সিঁথি—অপর্য্যাপ্ত তৈলনিষিক্ত কঠিন রুগ্ন কেশ হইতে নিদারুণ নেবুর তেলের গন্ধে ঘর ভরিয়া উঠিয়াছে। গায়ে জাপানী সিল্কের রামধনু-রঙের চুড়িদার পাঞ্জাবি, তাহার বুকপকেট হইতে বাঘ-আঁকা একটা রুমালের কিয়দংশ দেখা যাইতেছে, উত্তরীয়ের কোন বালাই নাই। পরণে বিলাতি মিলের কালো মকমল পাড়ের সূক্ষ্ম শাড়ি, পায়ে সবুজ রঙের ফুল-মোজা হাঁটুর উপরে লাল ফিতা দিয়া বাঁধা, বার্নিশ করা পাম্প-শু, তলাটা মঞ্জবুত ও টিকসই করতে আগাগোড়া লোহার নাল বাঁধানো, হাতে একগাছি হরিণের শিঙের হাতল দেওয়া বেতের ছড়ি,—কয়দিনের জাহাজের থকলে সমস্তই নোংরা হইয়া উঠিয়াছে—উহার আপাদমস্তক অপূর্ব্ব বারবার নিরীক্ষণ করিয়া কহিল, কাকাবাবু, এ লোকটিকে আপনি কোন কথা জিজ্ঞাসা না করেই ছেড়ে দিন—যাকে খুঁজছেন সে যে এ নয়, তার আমি জামিন হতে পারি।

 নিমাইবাবু চুপ করিরা রহিলেন। অপূর্ব্ব কহিল, আর যাই হোক, যাকে খুঁজচেন তাঁর কালচারের কথাটা একবার ভেবে দেখুন।

 নিমাইবাবু হাসিয়া ঘাড় নাড়িলেন, কহিলেন, তোমার নাম কি হে?

 আজ্ঞে, গিরীশ মহাপাত্র।

 একদম মহাপাত্র! তুমিও তেলের খনিতেই কাজ করছিলে, না? এখন রেঙ্গুনেই থাকবে? তোমার বাক্স-বিছানা ত খানাতল্লাসী হয়ে গেছে, তোমার ট্যাঁক এবং পকেটে কি আছে?

 তাহার ট্যাঁক হইতে একটি টাকা ও গণ্ডা ছয়েক পয়সা বাহির হইল, পকেট হইতে একটা লোহার কম্পাস, মাপ করিবার কাঠের একটা ফুটরুল, কয়েকটা বিড়ি, একটা দেশলাই ও একটা গাঁজার কলিকা বাহির হইয়া পড়িল।

 নিমাইবাবু কহিলেন, তুমি গাঁজা খাও?

 লোকটি অসঙ্কোচে জবাব দিল, আজ্ঞে না।

 তবে এ বস্তুটি পকেটে কেন?

 আজ্ঞে, পথে কুড়িয়ে পেলাম, যদি কারও কাজে লাগে তাই তুলে রেখেছি।

 জগদীশবাবু এইসময়ে ঘরে ঢুকিতে নিমাইবাবু হাসিয়া কহিলেন, দেখ জগদীশ, কিরূপ সদাশয় ব্যক্তি ইনি। যদি কারও কাজে লাগে তাই গাঁজার কল্‌কেটি

৫০