পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আপনাদের নজর পড়লে চাকরিও একটা জুটবে না। বামুনের ছেলে, বাঙলা লেখাপড়া, শাস্তর-টাস্তর সবই কিছু কিছু শিখেছিলাম, কিন্তু এমন অদেষ্ট যে—রাবুমশায় আপনারা—

 অপূর্ব্ব কহিল, আমি ব্রাহ্মণ!

 আজ্ঞে, তাহলে নমস্কার। এখন তবে আসি বাবুসাহের। রাম রাম—বলিতে বলিতে গিরীশ মহাপাত্র একটা উদ্গত কাশির বেগ সামলাইয়া লইয়া ব্যগ্রপদে সম্মুখের দিকে অগ্রসর হইয়া গেল।

 অপূর্ব্ব কহিল, এই সব্যসাচীটির পিছনেই কাকাবাবু সদলবলে এদেশ-ওদেশ করে বেড়াচ্চেন তলওয়ারকর! বলিয়া সে হাসিল।

 কিন্তু এই হাসিতে তলওয়ারকর যোগ দিল না। পরক্ষণে বাঁশী বাজাইয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিলে সে হাত বাড়াইয়া বন্ধুর করমর্দ্দন করিল, কিন্তু তখনও মুখ দিয়া তাহার কথাই বাহির হইল না। নানা কারণে অপূর্ব্ব লক্ষ্য করিল না, কিন্তু করিলে দেখিতে পাইত মুহূর্ত্ত কালের মধ্যে রামদাসের প্রশস্ত উজ্জ্বল ললাটের উপর যেন কোন এক অদৃশ্য মেঘের ছায়া আসিয়া পড়িয়াছে, এবং সেই সুদূর দুর্নিরীক্ষ-লোকেই তাহার সমস্ত মনশ্চক্ষু একেবারে উধাও হইয়া গিয়াছে।

 অপূর্ব্ব প্রথম শ্রেণীর যাত্রী, তাহার কামরায় আর কেহ লোক ছিল না। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইলে সে পিরাণের মধ্যে হইতে পৈতা বাহির করিয়া বিনা জলেই সায়ং সন্ধ্যা সমাপন করিল এবং যে সকল ভোজ্যবস্তু শাস্ত্রমতে স্পর্শদুষ্ট হয় না জানিয়া সে সঙ্গে আনিয়াছিল, পিতলের পাত্র হইতে বাহির করিয়া আহার করিল, জল ও পান তাহার ব্রাহ্মণ আরদালি পূর্ব্বাহ্নে রাখিয়া গিয়াছিল, এবং শয্যাও সে প্রস্তুত করিয়া দিয়া গিয়াছিল, অতএব রাত্রির মত অপূর্ব্ব ভোজনাদি শেষ করিয়া হাত-মুখ ধুইয়া পরিতৃপ্ত সুস্থচিত্তে শয্যা আশ্রয় করিল। তাহার ভরসা ছিল প্রভাতকাল পর্য্যন্ত আর তাহার নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটিবে না। কিন্তু ইহা যে কতবড় ভ্রম তাহা কয়েকটা স্টেশন পরেই সে অনুভব করিল। সেই রাত্রির মধ্যে বার-তিনেক তাহার ঘুম ভাঙাইয়া পুলিশের লোক তাহার নাম-ধাম ও ঠিকানা লিখিয়া লইয়াছে। একবার সে বিরক্ত হইয়া প্রতিবাদ করায় বর্ম্মা সব-ইনস্পেক্টর সাহেব কটুকণ্ঠে জবাব দেয়, তুমি ও ইউরোপীয়ান নও।

 অপূর্ব্ব কহে, না। কিন্তু আমি ফার্স্টক্লাস প্যাসেঞ্জার,—রাত্রে ত আমার তুমি ঘুমের বিঘ্ন করতে পার না।

 সে হাসিরা বলে, ও নিয়ম রেলওয়ে কর্ম্মচারীর জন্য,—আমি পুলিশ, ইচ্ছা করিলে আমি তোমাকে টানিয়া নীচে নামাইতে পারি।

৫৬