পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বেহালার বাক্স, না আছে বিছানা, না আছে কিছু। টিকিটের পয়সায় সে মদ কিনিয়া খাইয়াছে। এইমাত্র তাহার অপরাধ। বাঙালীর ছেলে পুলিশে লইয়া যায়,—অপূর্ব্ব তাহার ভাড়া চুকাইয়া দিল, আরও গোটা-পাঁচেক টাকা তাহার হাতে দিয়া তাড়াতাড়ি সরিয়া পড়িতেছিল, হঠাৎ সে হাতজোড় করিয়া কহিল, মশাই, আমার এই বেহালাখানা আপনি নিয়ে যান, বিক্রী করে টাকাটা আপনার কেটে নিয়ে বাকী আমাকে ফিরিয়ে দেবেন। তাহার কণ্ঠস্বরের জড়িমা সত্ত্বেও ইহা বুঝা গেল সে সজ্ঞানেই কথা কহিতেছে।

 অপূর্ব্ব কহিল, কোথায় ফিরিয়ে দেবো?

 সে কহিল, আপনার ঠিকানা বলে দিন, আপনাকে চিঠি লিখে জানাব।

 অপূর্ধ্ব কহিল, তোমার বেহালা তোমার থাক বাপু, ও আমি বিক্রী করতে পারবো না। আমার নাম অপূর্ব্ব হালদার, রেঙ্গুনের বোথা কোম্পানীতে চাকরি করি, যদি কখনো তোমার সুবিধে হয় টাকা পাঠিয়ে দিয়ো।

 সে ঘাড় নাড়িয়া কহিল, আচ্ছা মশাই নমস্কার—আমি নিশ্চয়ই পাঠিয়ে দেব। বার হবার পথ বুঝি এই দিকে? বেশ বড় সহর, না? বোধ হয় সব জিনিসই পাওয়া যায়। বাস্তবিক মশায়, আপনার দয়া আমি কখনো ভুলব না। এই বলিয়া সে আর একটা নমস্কার করিয়া বেহালার বাক্স বগলে চাপিয়া চলিয়া গেল। তাহার চেহারাটা এইবার অপূর্ব্ব লক্ষ্য করিয়া দেখিল। বয়স বেশি নয়, কিন্তু ঠিক কত বলা শক্ত। বোধ হয় সর্ব্বপ্রকার নেশার মাহাত্ম্যে বছর দশেকের ব্যবধান ঘুচিয়া গেছে। বর্ণ গৌর, কিন্তু রৌদ্রে পুড়িয়া তামাটে হইয়াছে; মাথায় রুক্ষ লম্বা চুল কপালের নীচে ঝুলিতেছে, চোখের দৃষ্টি ভাষা ভাষা, নাক খাঁড়ার মত সোজা এবং তীব্র। দেহ শীর্ণ, হাতের আঙ্গুলগুলো দীর্ঘ এবং সরু— সমস্ত দেহ ব্যাপিয়া উপবাস ও অত্যাচারের চিহ্ন আঁকা। সে চলিয়া গেলে অপূর্ব্বর কেমন যেন একটা কষ্ট হইতে লাগিল। তাহাকে আর অধিক টাকা দেওয়া বৃথা এমন কি অন্যায় একথা সে বুঝিয়াছিল, কিন্তু আর কোন কিছু একটা উপকার করা যদি সম্ভব হইত! কিন্তু এ লইয়া চিন্তা করিবার আর সময় ছিল না, তাহাকে টিকিট কিনিয়া গাড়ির জন্য প্রস্তুত হইতে হইল।

 পরদিন রেঙ্গুনে যখন সে পৌঁছিল তখন বেলা বারোটা। যেমন কড়া রৌদ্র তেমনি গুমোট গরম। তাহার উপর বিপদ এই হইয়াছিল যে, তাড়াতাড়ি ও অসাবধানে তাহার খাবারের পাত্রটা মুসলমান কুলি ছুঁইয়া ফেলিয়াছিল। স্নান নাই, আহার নাই—ক্ষুধায় তৃষ্ণায় ক্লান্তিতে তাহার দেহ যেন টলিতে লাগিল। কোন মতে বাসায় পৌঁছিয়া স্নান করিয়া এইবার শুইতে পাইলে যেন বাঁচে। ঘোড়ার গাড়ি

৬২