পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তেমনি ডাকাডাকি করতে লাগলাম, মিনিট-কুড়ি পরে তেওয়ারী হামাগুড়ি দিয়ে এসে কোনমতে দোর খুলে দিলে। তার চেহারা দেখে আমার বলবার কিছু আর রইল না। দিন-চারেক পূর্ব্বে সুমুখের বাড়ির নীচের ঘর থেকে বসন্তরুগী জন-দুই তেলেগু কুলিকে পুলিশের লোকে হাসপাতালে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের কান্না আর অনুনয়-বিনয় তেওয়ারী নিজের চোখেই দেখেচে,—আমার পা দুটো সে দুহাতে চেপে ধরে একেবারে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে বললে, মাইজী! আমাকে পেলেগ হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়ো না, তাহলে আমি আর বাঁচব না। কথাটা মিথ্যে নেহাৎ নয়, ফিরতে কাউকে বড় শোনা যায় না। সেই ভয়ে সে দোর জানালা দিবারাত্রি বন্ধ করে পড়ে আছে—পাড়ায় কেউ ঘুণাক্ষরে জানলে আর রক্ষে নেই।

 অপূর্ব্ব অভিভূতের ন্যায় তাহার মুখের দিকে চাহিয়া ছিল, কহিল, আর সেই থেকে আপনি একলা দিনরাত আছেন—আমাকে একটা খবর পাঠালেন না কেন? আমাদের আফিসের তলওয়ারকরবাবুকে ত জানেন। তাঁকে বলে পাঠালেন না কেন? ভারতী কহিল, কে যাবে? লোক কই? ভেবেছিলাম, হয়ত খবর নিতে একদিন তিনি আসবেন, কিন্তু এলেন না। এ বিপদ যে ঘটেচে তিনিই বা কি করে ভাববেন? তা ছাড়া জানাজানি হয়ে যাবার ভয় আছে।

 তা বটে। বলিয়া অপূর্ব্ব একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। অনেকক্ষণ পরে কহিল, আপনার নিজের চেহারা কি হয়ে গেছে দেখেচেন?

 ভারতী একটু হাসিয়া বলিল, অর্থাৎ এর চেয়ে আগে ঢের ভাল ছিল?

 অপূর্ব্বর মুখে সহসা এ কথার উত্তর যোগাইল না, কিন্তু তাহার দুই চোখের মুগ্ধ দৃষ্টি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার গঙ্গাজল দিয়া যেন এই তরুণীর সর্ব্বাঙ্গের সকল গ্লানি, সকল ক্লান্তি ধুইয়া মুছিয়া দিতে চাহিল। অনেকক্ষণ পরে কহিল, মানুষে যা করে না, তা আপনি করেচেন, কিন্তু এবার আপনার ছুটি। তেওয়ারী শুধু আমার চাকর নয়, সে আমার বন্ধু, আমার আত্মীয়—তার কোলে-পিঠে চড়ে আমি বড় হয়েছি। এখন থেকে তার রোগে আমিই সেবা করব—কিন্তু তার জন্যে আপনাকে আমি পীড়িত হতে দিতে পারব না। এখনো আপনার স্নানাহার হয়নি, আপনি বাসায় যান। সে কি এখান থেকে বেশি দূরে?

 ভারতী মাথা নাড়িয়া কহিল, আচ্ছা। বাসা আমার তেলের কারখানার পাশে, নদীর ধারে। আমি কাল আবার আসবো। দুইজনে নীচে নামিয়া আসিল; তালা খুলিয়া উভয়ে ঘরে প্রবেশ করিল। তেওয়ারীর সাড়া নাই, ঘুম ভাঙ্গিলেও সে অধিকাংশ সময় অজ্ঞান আচ্ছন্নের মত পড়িয়া থাকে। অপূর্ব্ব গিয়া তাহার বিছানার পাশে বসিল এবং যে দুই-চারিটি অপরিষ্কার পাত্র তখনও মাজিয়া ধুইয়া

৬৭