পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বসিল। কহিল, আমার মা এখানে নেই, আমি রোগে পড়ে গেলে তখন আপনি কি করবেন? তখন ত আপনাকেই থাকতে হবে।

 ভারতী কহিল, আমাকেই থাকতে হবে? আপনার বন্ধু তলওয়ারকরবাবুদের খবর দিলে হবে না?

 অপূর্ব্ব সজোরে মাথা নাড়িয়া বলিয়া উঠিল, না, তা কিছুতেই হবে না। আমার মা না হয় আপনি—একজনকে দেখতে না পেলে আমি কখ্‌খনো বাঁচব না। কাল যদি আমার বসন্ত হয়, এ কথা যেন আপনি কিছুতেই ভুলে যাবেন না! তাহার অনুরোধের শেষ দিকটা কি যে একরকম শুনাইল, ভারতী হঠাৎ আপনাকে যেন বিস্মৃত হইয়া গেল। বিছানার একপ্রান্তে বসিয়া পড়িয়া সে অপূর্ব্বর গায়ের উপর একটা হাত রাখিয়া রুদ্ধকণ্ঠে বলিয়া উঠিল,—না না, ভুলব না, ভুলব না! এ কি কখনো আমি ভুলতে পারি। কিন্তু কথাটা উচ্চারণ করিয়াই সে নিজের ভুল বুঝিতে পারিয়া চক্ষের পলকে উঠিয়া দাঁড়াইল। জোর করিয়া একটু হাসিয়া কহিল, কিন্তু ভুল হয়েও ত বিপদ কম ঘটবে না অপূর্ব্ববাবু! ঘটা করে আবার ত প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। কিন্তু ভয় নেই, তার দরকার হবে না। আচ্ছা, চুপ করে একটু ঘুমোন; বাস্তবিক, আমার অনেক কাজ পড়ে আছে।

 কি কাজ।

 ভারতী কহিল, কি কাজ? খাওয়া ত দূরে থাক, সারাদিন স্নান পর্য্যন্ত করবার সময় পাইনি।

 কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় স্নান করলে অসুখ করবে না?

 ভারতী বলিল, করতেও পারে, অসম্ভব নয়। কিন্তু স্নানের ঘরে যে কাণ্ড করে রেখেচেন তা পরিষ্কার করার পরে না নেয়ে কি কারু উপায় আছে নাকি? তারপর দুটো খেতেও হবে ত?

 অপূর্ব্ব অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া কহিল, কিন্তু সে সব আমি সাফ করে ফেলবো—আপনি যাবেন না। এই বলিয়া সে তাড়াতাড়ি উঠিতে যাইতেছিল। ভারতী রাগ করিয়া কহিল, আর বাহাদুরির দরকার নেই, একটু ঘুমোবার চেষ্টা করুন। কিন্তু এতবড় ঠুনকো জিনিসটিকে যে মা কোন্ প্রাণে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন আমি তাই শুধু ভাবি। সত্যি বলছি, উঠবেন না যেন। তিনি নেই, কিন্তু এখানে আমার কথা না শুনলে ভারি অন্যায় হবে বলে দিচ্চি। এই বলিয়া সে কৃত্রিম ক্রোধের স্বরে শাসনের হুকুম জারি করিয়া দিয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিল।

 উদ্বিগ্ন, শ্রান্ত ও একান্ত নির্জ্জীবের ন্যায় অপূর্ব্ব কখন যে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল সে জানিতেও পারে নাই, তাহার ঘুম ভাঙিল ভারতীয় ডাকে। চোখ মুছিয়া

৭৪