পাতা:পথের দাবী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

মানুষের ছোঁয়ায় মানুষের আপত্তি করবার কিছু নেই, তার গায়ের বাতাসে আর একজনের ঘরের বাতাস অপবিত্র হয়ে ওঠে না?

 অপূর্ব্ব তীব্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, নিশ্চয় নয়। মানুষের চামড়ার রঙ ত তার মনুষ্যত্বের মাপকাঠি নয়। কোন একটা বিশেষ দেশে জন্মানই ত তার অপরাধ হতে পারে না। মাপ করবেন আপনি, কিন্তু জোসেফ সাহেব ক্রীশ্চান বলেই ত শুধু আদালতে আমার কুড়ি টাকা দণ্ড হয়েছিল। ধর্ম্মমত ভিন্ন হলেই কি মানুষ হীন প্রতিপন্ন হবে? এ কোথাকার বিচার! এই বলচি আপনাকে আমি, এর জন্যই এরা একদিন মরবে। এই যে মানুষকে অকারণে ছোট করে দেখা, এই যে ঘৃণা এই যে বিদ্বেষ, এ অপরাধ ভগবান কখ্‌খনো ক্ষমা করবেন না।

 বেদনা ও লাঞ্ছনার মত মানুষের সত্যবস্তুটিকে টানিয়া বাহিরে আনিতে ত দ্বিতীয় পদার্থ নাই, তাই সে সমস্ত তুলিয়া অপমানকারীর বিরুদ্ধে অপমানিতের, পীড়কের বিরুদ্ধে পাড়িতের মর্ম্মান্তিক অভিযোগে সহস্রমুখ হইয়া উঠিয়াছিল। ভারতী তাহার দৃপ্ত মুখের প্রতি চাহিয়া এতক্ষণ নিঃশব্দে বসিয়াছিল। কিন্তু কথা তাহার শেষ হইতেই সে শুধু একটু মুচকিয়া হাসিয়া মুখ ফিরাইল। অপূর্ব্ব চমকিয়া উঠিল, তাহার মুখের উপর কে যেন সজোরে মারিল। ভারতীয় কোন প্রশ্নই এতক্ষণ সে খেয়াল করে নাই, কিন্তু সেগুলি অগ্নিরেখার মত তাহার মাথার মধ্যে দিয়া সশব্দে খেলিয়া গিয়া তাহাকে একেবারে বাক্যহীন করিয়া দিল।

 মিনিট খানেক পরে ভারতী পুনরায় যখন মুখ ফিরাইয়া চাহিল, তখন তাহার ওষ্ঠাধারে হাসির চিহ্নমাত্র ছিল না, কহিল, আজ শনিবারে আমাদের স্কুল বন্ধ, কিন্তু সমিতির কাজ হয়। চলুন না, নীচে গিয়ে আপনাকে ডাক্তারের সঙ্গে পরিচিত করে দিয়ে পথের দাবীর সভ্য করে দিই।

 তিনি বুঝি সভাপতি?

 সভাপতি? না, তিনি আমাদের মূল শিকড়। মাটির তলায় থাকেন, তাঁর কাজ চোখে দেখা যায় না।

 শিকড়ের প্রতি অপূর্ব্বর কিছুমাত্র কৌতূহল জন্মিল না। জিজ্ঞাসা করিল, আপনাদের সভ্যরা বোধহয় সকলে ক্রীশ্চান?

 ভারতী কহিল, না, আমি ছাড়া সকলেই হিন্দু।

 অপূর্ব্ব আশ্চর্য্য হইয়া কহিল, কিন্তু মেয়েদের গলা পাচ্ছি যে?

 ভারতী কহিল, তাঁরাও হিন্দু।

 অপূর্ব্ব মুহূর্ত্তকাল দ্বিধা করিয়া বলিল, কিন্তু তাঁরা বোধ হয় জাতিভেদ—অর্থাৎ কিনা, খাওয়া ছোঁয়ায় বিচার বোধ করি করেন না?

৯০