পাতা:পথের পাঁচালী.djvu/৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৮
পথের পাঁচালী

কি যে, তুমি করো বাবা! বড্ড জ্বালালে দেখচি। আর কোনদিন কোথাও নিয়ে বেরুচ্চিনে বলে দিলাম—এক্ষুনি হাত চুল্‌কে ফোস্কা হবে—পথের মাঝখান দিয়ে এত করে বলচি হাঁটতে—তা তুমি কিছুতেই শুনবে না।—

 হাত চুল্‌কুবে, কেন বাবা?

 হাত চুল্‌কুবে, বিষ বিষ—আল্‌কুশীতে কি হাত দেয় বাবা? শুঁয়ো ফুটে রি রি করে জ্বল্‌বে এক্ষুনি—তখন তুমি চীৎকার সুরু করবে।

 গ্রামের মধ্যে দিয়া হরিহর ছেলেকে সঙ্গে করিয়া খিড়কীর দোর দিয়া বাড়ি ঢুকিল। সর্ব্বজয়া খিড়কীর দোর খোলার শব্দে বাহিরে আসিয়া বলিল—এই এত রাত হোল! তা ওকে নিয়ে গিয়েচ, না একটা দোলাই গায়ে না কিছু!

 হরিহর বলিল, আঃ, নিয়ে গিয়ে যা বিরক্ত! এদিকে যায়, ওদিকে যায়, সাম্‌লে রাখতে পারিনে—আল্‌কুশীর ফল ধরে টান্‌তে যায়। পরে ছেলের দিকে চাহিয়া বলিল—কুঠির মাঠ দেখবো, কুঠির মাঠ দেখবো—কেমন, হল তো কুঠির মাঠ দেখা?



পথের পাঁচালী
অষ্টম পরিচ্ছেদ

সকাল বেলা। আটটা কি নয়টা। হরিহরের পুত্র আপন মনে রোয়াকে বসিয়া খেলা করিতেছে, তাহার একটা ছোট টিনের বাক্স আছে, সেটার ডালা ভাঙা। বাক্সের সমুদয় সম্পত্তি সে উপুড় করিয়া মেঝেতে ঢালিয়াছে,—একটা রং-ওঠা কাঠের ঘোড়া, চার পয়সা দামের, একটা টোল্-খাওয়া টিনের ভেঁপু-বাঁশী, গোটাকতক কড়ি—এগুলি সে মায়ের অজ্ঞাতসারে লক্ষ্মীপূজার কড়ির চুপড়ী হইতে খুলিয়া লইয়াছিল ও পাছে কেহ টের পায় এই ভয়ে সর্ব্বদা লুকাইয়া রাখে—একটা দু’পয়সা দামের পিস্তল, কতকগুলো শুক্‌নো নাটা ফল। দেখিতে ভাল বলিয়া তাহার দিদি কোথা হইতে অনেকগুলি কুড়াইয়া আনিয়াছিল, কিছু তাহাকে দিয়াছে, কিছু সে নিজের পুতুলের বাক্সে রাখিয়া দিয়াছে। খানকতক খাপরার কুচি। গঙ্গাযমুনা খেলিতে এই খাপরাগুলির লক্ষ্য অব্যর্থ বলিয়া বিশ্বাস হওয়ায় সে এগুলি সযত্নে বাক্সে রাখিয়া দিয়াছে, এগুলি তাহার মহা মূল্যবান সম্পত্তি। এতগুলি জিনিসের মধ্যে সবে সে টিনের বাঁশীটা কয়েকবার বাজাইয়া সেটির সম্বন্ধে বিগতকৌতূহল হইয়া তাহাকে এক পাশে রাখিয়া দিয়াছে। কাঠের ঘোড়া নাড়াচাড়া করা হইয়া গিয়াছে। সেটিও একপাশে পিঁজরাপোলের আসামীর ন্যায় পড়িয়া আছে। বর্ত্তমানে সে গঙ্গা-যমুনা খেলিবার খাপরাগুলিকে হাতে লইয়া মনে মনে দাওয়ার উপর গঙ্গা-যমুনার ঘর আঁকা কল্পনা করিয়া চোখ বুজিয়া খাপরা ছুঁড়িয়া দেখিতেছে, তাক্ ঠিক হইতেছে কিনা!

 এমন সময়ে তাহার দিদি দুর্গা উঠানের কাঁঠালতলা হইতে ডাকিল—অপু—ও—অপু—। সে