তাহার মায়ের শুইবার জায়গা খালি আছে। কারণ মা এখন রান্নাঘরের কাজ সারিয়া আসে নাই। তাহার বাবা আহারাদি সারিয়া পাশের ঘরে বসিয়া তামাক খাইতেছেন। বাবা বাড়ী আসিয়া দুৰ্গাকে পাড়া হইতে খুঁজিয়া আনিয়াছেন।
বাড়ী আসিয়া পর্য্যন্ত দুৰ্গা কাহারও সঙ্গে কোনো কথা বলে নাই। খাওয়া-দাওয়া সারিয়া আসিয়া চুপ করিয়া শুইয়াছে। অপু দুৰ্গার গায়ে হাত দিয়া জিজ্ঞাসা করিল—দিদি, মা কি দিয়ে মেরেছিল রে সন্দে বেলা? তোর চুল ছিঁড়ে দিয়েচে?
দুৰ্গার মুখে কোন কথা নাই।
সে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল—আমার উপর রাগ করিচিস্ দিদি? আমি তো কিছু করিনি।
দুৰ্গা আস্তে আস্তে বলিল—না বৈকি? তবে সতু কি করে টের পেলে যে পুঁতির মালা আমার বাক্সে আছে?
অপু প্রতিবাদের উত্তেজনায় উঠিয়া বসিল। না—সত্যি আমি তোর গা ছুঁয়ে বল্চি দিদি, আমি তো দেখাইনি। আমি জানিনে যে তোর বাক্সে আছে—কাল সতু বিকেল বেলা এসেছিল, ওর সেই বড় রাঙা ভাঁটাটা নিয়ে আমরা খেল্ছিলাম—তার পর, বুঝলি দিদি, সতু তোর পুতুলের বাক্স খুলে কি দেখছিল—আমি বল্লাম, ভাই, তুমি আমার দিদির বাক্সে হাত দিও না—দিদি আমাকে বকে—সেই সময়ে দেখেচে—
পরে সে দুর্গার গায়ে হাত বুলাইয়া বলিল—খুব লেগেচে রে দিদি? কোথায় মেরেচে মা?
দুৰ্গা বলিল—আমার কানের পাশে মা একটা বাড়ি যা মেরেছে—রক্ত বেরিয়েছিল, এখনও কন্ কন্ কচ্ছে, এইখানে এই দ্যাখ্ হাত দিয়ে! এই—
এইখানে? তাই তো রে! কেটে গিয়েছে যে? একটু পিদিমের তেল লাগিয়ে দেব দিদি?
থাকগে—কাল পালিতদের বাগানে বিকেল বেলা যাব বুঝ লি? কামরাঙ্গা যা পেকেছে! এই এত বড় বড়, কাউকে যেন বলিসনে! তুই আর আমি চুপি চুপি যাবো—আমি আজ দুপুর বেলা দুটো পেড়ে খেয়েচি—মিষ্টি যেন গুড়—
এদিনের ব্যাপারটা এইরূপে ঘটিল।
অপু বাবার আদেশে তালপাতে সাতখানা ক খ হাতের লেখা শেষ করিয়া কি করা যায় ভাবিতে ভাবিতে বাড়ীর মধ্যে দিদিকে খুঁজিতে গেল। দুৰ্গা মায়ের ভয়ে সকালে নাহিয়া আসিয়া ভিতরের উঠানে পেঁপেতলায় পুণ্যিপুকুরের ব্ৰত করিতেছে। উঠানে ছোট্ট চৌকোণা গর্ত্ত কাটিয়া তাহার চারিধারে ছোলা, মটর ছড়াইয়া দিয়াছিল—ভিজে মাটিতে সেগুলির অঙ্কুর বাহির হইয়াছে—চারিদিকে কলার ছোট বোগ পুঁতিয়া ধারে পিটুলি গোলার আল্পনা দিতেছে—পদ্মলতা,—পাখী, ধানের শীষ্, নতুন ওঠা সূর্য্য।