পাতা:পথের পাঁচালী.djvu/৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পথের পাঁচালী
৫৩

মুস্কিল হ'য়ে যাচ্ছে। মহেশ বিশ্বেসের শ্বশুরবাড়ীর বিষয়-আশয় নিয়ে কি গোলমাল বেধেছে, বিশ্বেস মশায় গিয়েচে সসেখানে চলে—সেই আসল মালিক কিনা। তাই আবার একটু পিছিয়ে গেল; আবার এদিকেও তো অকাল পড়চে আষাঢ় মাস থেকে।

 —আর সেই যে বাসের জায়গা দেবে—বাস করাবে বলেছিল, তার কি হোল?

 —এই নিয়ে একটু মুস্কিল বেধে গেল কিনা? ধরো যদি মন্তর নেওয়া পিছিয়ে যায়, তবে ও কথা আর কি ক'রে ওঠাই?

 সর্ব্বজয়া খুব আশায় আশায় ছিল, সংবাদ শুনিয়া আশাভঙ্গ হইয়া পড়িল। বলিল, তা অওখানে না হয়, অন্য কোনো জায়গায় দেখো না? বিদেশে মান আছে, এখানে কেউ পৌঁছে? এই দ্যাখো আম-কাঁটালের সময় একটা আম-কাঁটাল ঘরে নেই—মেয়েটা কাদের বাড়ী থেকে আজ দু'টো আধপচা আম নিয়ে এল।—পরে সে উদ্দেশে বাড়ীর পশ্চিম দিকে মুখ ফিরাইয়া বলিল,—এই ঘরের দোর থেকে ঝুড়ি ঝুড়ি আম পেড়ে নিয়ে যায়—বাছারা আমার চেয়ে চেয়ে দ্যাখে,—এ কি কম কষ্ট?

 বাগানের কথার উল্লেখে হরিহর বলিল—উঃ, ও কি কম ধড়িবাজ নাকি? বছরে পঁচিশ-টাকা খাজনা ফেলে ঝেলে হোতো, তাই কিনা লিখে নিলে পাঁচ টাকায়! আমি গিয়ে এত করে বললাম, কাকা, আমার চছেলেটা মেয়েটা আছে, ঐ বাগানে আম-জাম কুড়িয়ে মানুষ হচ্চে। আমার তো আর কোথাও কিছু নেই। আর ধরুন আমাদের জ্ঞাতির বাগান—আপনার তো ঈশ্বর ইচ্ছেয় কোনো অভাব নেই, দু'টো অত বড় বাগান রয়েচে, আম জাম নারকেল সুপারি—আপনার অভাব কি? বাগানখানা গিয়ে ছেড়ে দিন গে যান। তা বল্লে কি জানো? বল্লে নীলমণি দাদা বেঁচে থাকতে ওর কাছে নাকি তিনশো-টাকা ধার করেছিল, তাই অমনি করে শোধ করে নিলে। শোন কথা! নীলমণিদাদার বড্ড অভাব ছিল কিনা, তাই তিনশো টাকার জন্যে গিয়েছে ভুবন মুখুয্যের কাছে হাত পাততে। বৌদিকে ভালমানুষ পেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে নিলে আর কি!

 —ভালমানুষ তো কত! সেও নাকি বলেছে যে জ্ঞাতি শত্তুর—ওর হাতে বাগান থাকলে তো আর কিছু পাওয়া যাবে না, ফল পাকুড় এমনিই খাবে, তার চেয়ে কিছু কম জমাতেও যদি বন্দোবস্ত হয়, খাঁজনাটা তো পাওয়া যাবে।

 হরিহর বলিল—খাজনা কি আমি দিতাম না? বাগান জমা দেবে, তাই কি আমায় জানতে দিলে? বৌদিদিকে লুচি-মোহনবভোগ খাইয়ে আট ক'রে চুপি চুপি লিঁখিয়ে নিলে।

 বৈকালের দিকটা হঠাৎ চারিদিক অন্ধকার করিয়া কালবৈশাখীর ঝড় উঠিল। অনেকক্ষণ হইতে মেঘ মেঘ করিতেছিল, তবুও ঝড়টা যেন খুব শীঘ্র আসিয়া পড়িল। অপুদের বাড়ীর সামনের বাঁশঝাড়ের বাঁশগুলা পাঁচিলের উপর হইতে ঝড়ের বেগে হটিয়া ওধারে পড়াতে বাড়ীটা যেন ফাঁকা ফাঁকা দেখাইতে লাগিল—ধূলা, বাঁশপাতা, কাঁটালপাতা, খড়, চারিধার হইতে উড়িয়া তাহাদের উঠান ভরাইয়া ফেলিল। দুর্গা বাটীর বাহির হইয়া আম কুড়াইবার জন্য দৌড়িল—অপুও দিদির পিচছু পিছু ছুটিল। দুর্গা ছুটিতে