পাতা:পথের পাঁচালী.djvu/৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৮
পথের পাঁচালী

দিয়ে গিয়ে ধরে তুলবে—এতে মাগীরও শিক্ষে আছে, ও মাগী কি কম নাকি?—ও মা, ভাবলাম বিষ্টি থেমেচে, যাই একবার বাগানটা গিয়ে দেখে আসি—এই এও বড় নারকোলটা কুড়িয়ে নিয়ে একেবারে দুড়্‌দুড়্ দৌড়?—এত শত্তুরতা যেন ভগবান্ সহ্যি না করেন—উচ্ছন্ন যান্, উচ্ছন্ন যান্—এই ভস্ সন্দে বেলা বলচি, আর যেন নার্‌কোল খেতে না হয়—একবার শীগগির যেন ছাতিমতলা-সই হন—

 সর্ব্বজয়া খিড়কীর বাহিরে কাঠ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ছেলেমেয়ের বর্ষণ সিক্ত কচিমুখ মনে করিয়া সে ভাবিল, যদি গালাগাল ওদের লাগে! বাবা—যে লোক! দাঁতে বিষ আছে! কি করি? কথাটা ভাবিতেই তাহার গা শিহরিয়া উঠিয়া সর্ব্বশরীর যেন অবশ হইয়া গেল। সে আর মুখুয্যেবাড়ী ঢুকিল না—আশশেওড়া বনে, বাঁশঝাড়ের তলায় বর্ষণস্তব্ধ সন্ধ্যায় জোনাকী জ্বলিতেছে, পা যেন আর উঠিতে চাহে না—ভয়ে ভয়ে সে জল তুলিবার ছোট্ট বালতিটা ও ঘড়া কাঁধে লইয়া বাড়ীর দিকে ফিরিল।

 পথে আসিতে আসিতে ভাবিল—যদি নারকোলটা ওদের ফেরৎ দিই—তাহলেও কি গাল লাগবে? তা লেন লাগবে—যার জিনিস তাকে তো ফেরৎ দেওয়া হ'ল তা কখনো লাগে?

 বাড়ীতে পা দিয়াই মেয়েকে বলিল—দুগ্‌গা, নারকোলটা সতুদের বাড়ী দিয়ে আয় গিয়ে।

 অপু ও দুর্গা অবাক হইয়া মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল—

 দুর্গা বলিল—এখ্‌খুনি?

 —হ্যাঁ,—এখ্‌খুনি দিয়ে আয়। ওদের খিড়কীর দোর খলা আছে। চট্ ক'রে যা। ব'লে আয়, আমরা কুড়িয়ে পেইছিলাম, এই নাও দিয়ে গেলাম।

 —অপু আমাকে একটু দাঁড়াবে না, মা? বড্ড অন্ধকার হয়েচে, চল্ অপু আমার সঙ্গে।

 ছেলেমেয়ে চলিয়া গিয়া সর্ব্বজয়া তুলসীতলায় প্রদীপ দিতে দিতে গলায় আঁচল দিয়া প্রণাম করিয়া বলিল—ঠাকুর নারকোল ওরা শত্তুরতা ক'রে কুড়ুতে যায়নি সে তো তুমি জানো, এ গাল যেন ওদের না লাগে। দোহাই ঠাকুর, ওদের তুমি বাঁচিয়ে বর্ত্তে রেখো ঠাকুর। ওদের তুমি মঙ্গল কোরো। তুমি ওদের মুখের দিকে চেও। দোহাই ঠাকুর।


পথের পাঁচালী
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

গ্রামের প্রসন্ন গুরুমহাশয় মারীতে একখানা মুদীর দোকান করিতেন। এবং দোকানেরই পাশে তাঁহার পাঠশালা ছিল। বেত ছাড়া পাঠশালায় শিক্ষাদানের বিশেষ উপকরণ-বাহুল্য ছিল না। তবে এই বেতের উপ অভিভাবকদেরও বিশ্বাস গুরুমহাশয়ের অপেক্ষা কিছু কম নয়। তাই তাঁহারা গুরুমহাশয়কে বলিয়া দিয়াছিলেন, ছেলেদের শুধু পা খোঁড়া এবং চোখ কানা না হয়, এইটূকু মাত্র নজর রাখিয়া তিনি যত ইচ্ছা বেত চালাইতে পারেন। গুরুমহাশয়ও তাঁহার শিক্ষাদানের উপযুক্ত ক্ষমতা ও