বর্ণনা! এই কবির “চঞ্চল লোচনে বঙ্ক নেহারণী, অঞ্জন শোভন তায়; জনু ইন্দীবরে পবন ঠেলল অলি-ভরে উলটায়” (কজ্জ্বলযুক্ত চক্ষুর অপাঙ্গ দৃষ্টি—চক্ষের তারা এক কোণে সরিয়া পড়েছে। যেমন ভ্রমর-পদ-পীড়িত নীলোৎপলকে পবনে ঠেলিয়া ফেলিতেছে)। চণ্ডীদাসের—“চলে নীল শাড়ী, নিঙাড়ি নিঙাড়ি—পরাণ সহিত মোর”, রায় শেখরের—“তুঙ্গমণি-মন্দিরে বিজলী ঘন সঞ্চরে, মেঘরুচি বসন পরিধানা” প্রভৃতি শত শত পদে অপূর্ব্ব কবিত্ব ফুটিয়াছে। আবার কোন কোন পদে কবিত্বের সঙ্গে অধ্যাত্ম-মহিমা প্রকাশ পাইয়াছে, যেন বনের ফুল দেবতার নৈবেদ্যে স্থান পাইয়াছে। জ্ঞানদাসের—
“রূপ লাগি আখি ঝুরে, গুণে মন ভোর,
প্রতি অঙ্গ লাগিকাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর,
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কাঁদে,
পরাণ পীরিতি লাগি স্থির নাহি বাঁধে।”
কে যেন জোড় ভাঙ্গিয়া বেজোড় করিয়া দিয়াছে, গল্পকথিত গ্রীক দেবতার ন্যায় কে যেন অখণ্ডকে দ্বিখণ্ডিত করিয়া ফেলিয়াছে, সেই দুই খণ্ড পরস্পরের সঙ্গে জোড়া লাগিবার জন্য বিরহে হাহাকার করিতেছে। জীব যাঁহার অংশ—তাঁহার বিরহে মন ব্যাথাতুর হইয়া আছে। যেরূপ সারাদিন সূর্য্যের মত রশ্মী পৃথিবীতে আসিয়া ছুটাছুটি করে, কিন্তু সন্ধ্যায় সূর্য্যের সঙ্গে মিলিত না হইয়া পৃথিবীর মাটিতে পড়িয়া থাকে না—সেইরূপ জীব তাঁহাকে ছাড়া যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ দশ ইন্দ্রিয় দিয়া হাতড়াইয়া তাহাকে খুঁজিয়া বেড়ায়। শেষে “পরাণ পীরিতি লাগি স্থির নাহি বাঁধে”—তাঁহার প্রেম ছাড়া প্রাণ অস্থির হইয়া উঠে। এইরূপ আর একটি গান আছে, তাহা লোচন দাসের। বঙ্কিমচন্দ্র কমলাকান্তের দপ্তরে তাহার একটা ব্যাখ্যা দিয়াছেন, উহা তাঁহার মত মনস্বী ও সাহিত্য-রস-বোদ্ধার যোগ্য, কিন্তু তাহা ঠিক বৈষ্ণবের মত নহে—
‘‘এস এস বঁধু এস, আধ আঁচরে ব’স,
আজি নয়ন ভরিয়া তোমা দেখি।